Wednesday, December 30, 2015
Wednesday, December 23, 2015
Thursday, December 10, 2015
‘আর্টিজান’, ‘আর্টিস্ট’-ও!
![]() |
কাকা তোনি ও গৌরব নাটেকারের মাঝে রাফায়েল নাদাল, বৃহস্পতিবার দিল্লিতে |
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
কতটা পথ পেরলে তবে ‘নাদাল’
হওয়া যায়!
ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল
কানাডার সাংবাদিক, লেখক। সাফল্য সম্পর্কিত কয়েকটি বই লিখেছেন। গবেষণা ও বিশ্লেষণে
প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর ‘দশ হাজার ঘণ্টা’ অনুশীলনে সাফল্যের রাস্তা খুঁজে পাওয়ার
সহজ পথ। সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের পার্থক্য, তাঁর মতে, একজন ন্যূনতম দশ হাজার
ঘণ্টা অনুশীলন করেছেন, অনুশীলন করতে করতে প্রেমে পড়ে গিয়েছেন তাঁর পেশার সঙ্গে,
দক্ষতা অর্জিত হয়েছে এমন স্তরে, কম অনুশীলনের মাধ্যমে যাঁরা সেই সাফল্য অর্জন করতে
চেয়েছেন, পিছিয়ে পড়েছেন সহজেই। গ্ল্যাডওয়েলের গবেষণায় ‘সহজাত প্রতিভা’ অর্থহীন।
পরিশ্রমের ঘামেই তাকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে রূপ দেওয়া সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত ৪০ ঘন্টা
করে অন্তত পাঁচ বছর একমুখী সাধনায় মেতে থাকলে পাওয়া সম্ভব সেই ‘দশ হাজার ঘণ্টা’-র
জাদুকাঠি। যাঁরা দিয়েছেন, সাফল্য তাঁদের পায়ের কাছে এসে মুখ ঘষেছে আদরে-সোহাগে,
সহজ বিশ্লেষণ!
খেলার জগতে বর্ণাশ্রম
আছে। আমরা-ওরা বিভাজন পরিষ্কার। একদল শিল্পী, অন্য দল শ্রমিক। আমাদের সাধের বাংলায়
যেমন, বিশ্বের বহু দেশই শিল্পীদের দেখে সম্মানের চোখে। কারিগর হলে মেলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
এবং, এমন একটা ভাবনা সুপ্রচলিত যে, শিল্পীর কাছে সবই সহজ। যে কোনও পেশার শীর্ষে
উঠতে তাঁকে অনেক কম পরিশ্রম করতে হয় শ্রমিক শ্রেণীর তুলনায়। ডাহা মিথ্যে। এই
বিশ্বে কোনও কিছুই সস্তায় মেলে না। উপযুক্ত মূল্য চুকিয়ে তবেই পাওয়া যায়
স্বপ্নলোকের চাবিকাঠি।
যে কোনও শিল্পের মতোই খেলাও
পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর
বছর, একই কাজ করে যেতে হয়। চালিয়ে যেতে হয় নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। যে-কাজ করছি তাতে
দক্ষতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে। গায়ক যেমন জীবনভর গলা সেধে যান, ‘সা’ লাগানোর
সাধনায় একটা দিনের ফাঁকি তাঁর জীবনে তাঁর স্বপ্নাতীত। নিক বলটিয়েরি-র আকাদেমি একের
পর এক চ্যাম্পিয়ন উপহার দিয়েছে টেনিসকে। তাঁর সাফল্যের দেশে পৌঁছনোর রাস্তাও সহজই
ছিল। ‘দিনে দেড়-দু’হাজার বল পাঠাও নেটের ওধারে, সপ্তাহে দশ হাজার, মাসে ৪০ হাজার
বল। ফল দেখো প্রতিযোগিতা শেষে!’ সেই ঘুরেফিরে গ্ল্যাডওয়েলের দশ হাজার ঘণ্টার গল্প।
বাজার থেকে মা কিছু আনতে বললে ছোট্ট দিয়েগো মারাদোনা পায়ে একটা কাপড়ের বল নিয়ে বুয়েনস
আইরেসের বস্তি ভিয়া ফিওরিতোর জনবহুল রাস্তার লোককে কাটাতে কাটাতে যেত, ফিরত।
বস্তির ভিড়ভাট্টায় ড্রিবলের সেই অনুশীলন পরবর্তীকালে বিশ্বসুদ্ধ মানুষকে দিয়েছিল
বিশুদ্ধ আনন্দের পবিত্র স্বাদ। কীভাবে করছেন, কোথায় করছেন নয়, গুরুত্বপূর্ণ
স্কিল-কে নিখুঁত স্তরে উত্তরণ ঘটাতে কতটা সময় ব্যয় করছেন, অনলস পরিশ্রমে।
দিল্লি এসে মহেশ ভূপতির টেনিস
আকাদেমির সঙ্গে জুড়ে দিলেন নিজের স্পেনের আকাদেমিকেও, যাতে ভারতের শিক্ষার্থীরা
যেতে পারেন মায়োরকায়, নাদালের জন্মস্থানে, তাঁর আকাদেমিতেও অনুশীলন করতে। সে কারণে
সকালে দিল্লির লন টেনিস আকাদেমিতে বাচ্চাদের সঙ্গে ক্লিনিক। সবাইকে সুযোগ দিলেন
তাঁর বিরুদ্ধে একটি করে পয়েন্ট খেলতে। দু-তিন শটের পরই যদি কোনও শিশু বা কিশোর
শিক্ষার্থী নেটে বা বাইরে পাঠিয়ে দেয় বল, নিজেই উৎসাহ বাড়ালেন ‘কন্টিনিউ’ বলে।
খেলাশেষে সবার মাথায়-গা্য়ে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়, ডেকে ডেকে কারও চুলটা
নেড়ে, কারও গালে আদরের চাপড় মেরে, প্রায প্রত্যেকের জার্সিতে সই করে দিয়েই ছাড়লেন
কোর্ট।
প্রেস কনফারেন্স শেষে
আবার সেই কোর্টেই ফিরে এলেন তরতাজা। রোজকার নেটের ওধারে বল পাঠানোর কাজটা যে সকালে
সেভাবে করা হয়নি যেভাবে করতে অভ্যস্ত। কী আসে যায় প্রদর্শনী ম্যাচে, ভাবনা যাঁর
ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে সাহস পায় না। হিটিং পার্টনার থাকলেন নিজের ছন্দে, কাকা-কোচের
তীক্ষ্ণ নজরদারি, ঘণ্টাখানেক চলল বল-পেটানোর সেই নির্মম নির্দয় নিরলস সাধনা। আরকে
খান্না টেনিস আকাদেমির গ্যালারিতে, কোর্টের অত কাছে বসে সেই অনুশীলন দেখতে দেখতে
ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল নিজেকেই। যে বিষাক্ত টপস্পিনওয়ালা ফোরহ্যান্ডগুলো টিভি-তে
দেখতে দেখতে, উইকিপিডিয়ালব্ধ তথ্য যে শটগুলোর রিভোলিউশন প্রতি-মিনিট বলছে গড়ে ৩২০০
(সাম্প্রাস বা আগাসির ক্ষেত্রে যা ১৮০০-১৯০০ বড়জোর, ফেডেরারের ২৭০০!), সর্বোচ্চ
৪৯০০, যেগুলো শেষ হয় ব্রায়ান লারার অতি-পরিচিত কাঁধের ওপরে পৌঁছে-যাওয়া
অনিন্দ্যসুন্দর ফলো-থ্রুতে, এভাবে মিনিট পঁয়তাল্লিশ দেখার সুযোগ কি আর আমাদের দেশে
রোজ রোজ বা বছর বছরও হয়?
আর সাফল্যের রহস্য
সমাধানের ঝাঁপিটাও খুলে তুলে ধরলেন টেনিস-পিপাসু ভারতীয় সাংবাদিকদের সামনে। ‘যখন
ছোট ছিলাম, স্বপ্ন দেখতাম রোলাঁ গারোয় খেলব, উইম্বলডনে, পেশাদার টেনিস প্রতিযোগিতাগুলোতে।
বাচ্চারা যে স্বপ্নগুলো দেখে আর কী! সেই স্বপ্নটাকে সত্যি করে তোলার জন্য আমার
প্রেরণা, আমার প্যাশন আর আমার পরিশ্রমই শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটাকে সফল করে তুলেছে।
অন্যরাও এই পথে এভাবেই চললে সাফল্য আসবেই। আমি তো পেরেছি, ওরা পারবে না কেন? যা
করি, ভালবেসে। আমাদের তুমুল প্যাশন। কাজটাকে ভালবাসি বলেই রোজ করি। করতেই হবে।
নিজেকে উন্নত করতে। প্রতি বছর নিজেকে আরও ভাল জায়গায় দেখতে চেয়ে। এটাই রাস্তা,
একমাত্র। রহস্য নেই কোনও।’ বিশ্বের যে কোনও পেশার যে কোনও চূড়ান্ত সফল যা বলে
থাকেন, রোজ। আমরা যা শুনি আর ভুলে যাই, রোজ! আর বারবার সাফল্যের রহস্য সন্ধানে
প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে যাই, কাটাছেঁড়া করতে চাই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, যেন
সাফল্যের রহস্য সমাধানে আমরা প্রত্যেকেই এক-একজন প্রদোষ মিত্তির! শেষে পড়ে থাকি
সেই তিমিরেই, আমাদের অতি-সাধারণ ছাপোষা গড়পড়তা পিএফ-গ্র্যাচুইটি নির্ভর চরম আটপৌরে
রিক্ততায়।
‘আর্টিজান’ (artisan) নাদাল সমালোচকের মন-ভোলানো ‘আর্টিস্ট’ নন। কিন্তু, তাঁর চেয়ে বড় শিল্পী-ই বা কতজন!
Subscribe to:
Posts (Atom)