কাশীনাথ ভট্টাচার্য
মানুষ বড় হ্য় স্বভাবে,
আচরণে।
‘লাগে রহো মুন্নাভাই’
দেখেছিলেন? রেডিও জকি হিসেবে মুন্নাভাই তখন শেখাচ্ছিলেন গান্ধীগিরি। এক কন্যা
রেস্তোরাঁয় বসে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভাবী বর আসছে দেখা করতে, কিন্তু এক-দু’মিনিটে কী
করে বুঝব সে আসলে কেমন? ওইটুকু সময়ের জন্য এসে সে তো ভাল ব্যবহারই করবে, তাই না?’
পর্দার মহাত্মার পরামর্শে মুন্নাভাইয়ের তাৎক্ষণিক
জবাব, ‘মানুষকে পরখ করতে গেলে দ্যাখো, নিজের চেয়ে যাদের সামাজিক অবস্থান নিচে
তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে। মানে, যদি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারকে শিস্ দিয়ে ডাকে, বা
মুখ দিয়ে চুচুচু আওয়াজ করে, ওখান থেকে পালিয়ে যেও!’
রোবের্তো কার্লোস ফুটবল
বিশ্বে বিশেষ পরিচিত। এখানে, বিশ্ব মানে ২০৭ দেশ কমপক্ষে, সাত
দেশের বিশ্ব নয়! নওবা সিং কে, ১৩০ কোটির মধ্যে এক কোটি ভারতীয় খুব বেশি হলে বলতে
পারবেন। তাঁকে পাশে নিয়ে আইএসএল-এর সাংবাদিক সম্মেলন। যখন সব প্রশ্ন
স্বাভাবিকভাবেই ধাবিত কার্লোসের দিকে, বারবার অনুরোধ, নওবা-কে প্রশ্ন করার জন্য।
তাঁকে অনেকগুলি প্রশ্নের পর যখন প্রথম প্রশ্ন গেল নওবার দিকে, নিজের সামনে-থাকা
মাইক্রোফোন সুইচ টিপে বন্ধ করলেন, বাঁ হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিলেন নওবার
সামনের মাইক্রোফোনের আলো। তাতেও অস্বস্তিতে নওবা যখন কথা বলছেন আস্তে আস্তে, নিজের
মাইক্রোফোন ‘অন’ করে এগিয়ে দিলেন নওবার দিকে, এমনকি, নওবার মাইক্রোফোনও এগিয়ে এনে
দিলেন নওবারই মুখের কাছাকাছি। পাশে-বসা অনুবাদককেও বলে দিলেন নওবাকে বলতে যে, যেন
মুখটা মাইক্রোফোনের কাছে এনে কথা বলে। এবং, শেষে নিশ্চিত করে দিলেন যে, তিনি আর
কোনও কথা বলবেন না, দেবেন না কোনও প্রশ্নের উত্তর, বাকি সব প্রশ্নই যেন করা হয়
নওবা-কেই!
কোচ বলে তাঁকে এমন করতেই
হত, বাধ্যবাধকতা ছিল না, নেই। অন্য কোচরাও এমন করতেন তা হলে। কই করেন না তো!
সহজাত অপত্যে মুগ্ধ করে
আরও একবার বুঝিয়ে গেলেন রোবের্তো কার্লোস, ‘উত্তম’-রা নিশ্চিন্তেই চলেন নওবাদের
সঙ্গে, চিরকাল!
*****
তিনি তখন কোমরে হাত দিয়ে
দাঁড়িয়ে!
জিনেদিন জিদান
বাড়িয়েছিলেন বল, মাথার ওপরে। দুরন্ত রিসিভ থিয়েরি অঁরির। এবং বক্সে ওই জায়গায়
পায়ে-বলে ঠিকঠাক হলে যা হয়, গোল করতে ভুল করেননি অঁরি। আর ওই গোলেই বিদায়
ব্রাজিলের, ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে, কোয়ার্টার ফাইনালে।
রোবের্তো কার্লোস
পরিষ্কার জানালেন, ওগুলো আর মনে রাখতে চান না। ‘ট্রফি হাতে ছবি, মনে রাখার মতো
ব্যাপার। সেই ছবিও প্রচুর তুলেছি। ওগুলোই মনে রাখতে চাই। যেখানে হেরেছি, শুধু শুধু
মনে রাখতে যাব কেন?’
অবশ্য পরেই বিশ্লেষণও
করলেন। ‘ওই বিশ্বকাপে আসলে আমরা গিয়েছিলাম খুব ক্লান্ত হয়ে। রোনালদিনিও, কাকা,
আমরা সবাই। তা ছাড়া, বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতিও ঠিকঠাক হয়নি। ফুটবল ওভাবে তো হয়
না! প্রচুর খেলতে হয়েছিল ক্লাবের হয়ে। প্রায় বিশ্বকাপের আগে পর্যন্তই। প্রভাব
পড়েছিল খেলায়। কিন্তু, ওগুলো আসছে কেন? তার আগের বিশ্বকাপ ভাবুন। রোনালদোর ওই
অসাধারণ খেলা, রিভালদোর, আমাদের সবার। বিশ্বকাপ হাতে ছবি। মনে রাখার জন্য এর চেয়ে
ভাল আর কী!’
ঠিকই বলেছিলেন হয়ত
নিজেদের দিক দিয়ে। রোনালদিনিও সেই ২০০৬ নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন বার্সেলোনায়। লা
লিগা তো বটেই, এনে দিয়েছিলেন বার্সার দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ফাইনালে
আর্সেনালকে হারিয়ে। তখন বার্সেলোনা পরে পেপ গারদিওলার আমলের
জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসি-অঁরি-এতোর মতো নয়। একা রোনালদিনিওকেই টানতে হয়েছিল শেষ
পর্যন্ত। এতো-গিউলি-দেকোদের নিয়ে, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডের আমলে। মেসি আহত থাকায়
খেলতে পারেননি, এমনকি জায়গা পাননি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দলেও। বিশ্বকাপের আগে
রোনালদো ছিলেন অসুস্থ। খেলতে পারবেন কিনা, সংশয় ছিল। প্রায় জোর করেই রোনালদোকে
খেলানো হয়েছিল, বিশ্বকাপে জার্ড মুলারের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভাঙার জন্য, যা শেষ
পর্যন্ত ভেঙেও ছিলেন। এবং যে রেকর্ড নিজের দেশে অনুরূপ পরিস্থিতিতে ভাঙতেও
দেখেছিলেন রোনালদো, আর এক জার্মান মিরোস্লাভ ক্লোজেকে!
*****
তিনটি বিশ্বকাপ
খেলেছিলেন। ১৯৯৮, ২০০২ এবং ২০০৬। তিনটি ম্যাচ হেরেছিলেন বিশ্বকাপে। একবার নরওয়ের
কাছে, ১৯৯৮ গ্রুপ লিগে। বাকি দুবারই বিপক্ষে ফ্রান্স এবং জিনেদিন জিদান! ১৯৯৮
ফাইনালে হেডে জিদানের দু-গোল, শেষে ০-৩ হার ফাইনালে। আট বছর পরেও জিদানের পাসের
কাছে হার। সেই জিদানই আবার সতীর্থ, রেয়াল মাদ্রিদে। ২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে
সেই রোবের্তো কার্লোসের উঁচু করে তোলা বল মাটিতে পড়তে না-দিয়ে সরাসরি বাঁ পায়ের
ভলিতে গোল জিদানের এবং রেয়ালের ইউরোপে নবম খেতাব। উয়েফার বিচারে চ্যাম্পিয়ন্স
লিগের সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। তাই সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছেন এমন সেরা
ফুটবলার বেছে নিতে গিয়ে জিদান সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হবেন রোবের্তো, আশ্চর্যের কিছু
নেই।
‘অনেকের সঙ্গে ও বিপক্ষে
খেলেছি। আমাদের গালাকতিকোস ছিল। জিদান, রোনালদো, ফিগো, রাউল, বেকহ্যাম, কাসিয়াস,
আমরাও ছিলাম। প্রত্যেকে দুর্দান্ত ফুটবলার। খেলার আনন্দ উপভোগ করেছি চুটিয়ে। আসলে
কী বলুন তো, পেলে-মারাদোনা-রোনালদো-জিদান কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। ওঁরা
একবারই আসেন, মাতিয়ে দিয়ে যান ফুটবল বিশ্বকে। হ্যাঁ, তবুও আলাদা করে জিদানের কথা
বলতেই হবে। খেলেছি, সঙ্গে যেমন, বিপক্ষেও। অন্যরকম, আলাদা সবার চেয়ে।’
স্বপ্ন খুন যাঁর মাথায় ও
পায়ে দু-দু’বার, অকৃত্রিম বন্ধু হলেও তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে কার্লোস সিলমোহর
দিলেন চিরন্তন সত্যে যে, পরাজয় স্বীকার না-করতে জানলে জয়ী হওয়া যায় না কখনও।
আর, তাঁর চোখে সেরা লেফট
ব্যাক? সরাসরি না বললেও নাম করলেন পাওলো মালদিনির। ‘অমন আর কে?
পেলে-মারাদোনা-জিদানদের মতোই মালিদিনিও একজনই, একবারই আসে।’
![]() |
সইও দিলেন কার্লোস |
*****
বঙ্গ ফুটবল-বাজারে এমনকি
ব্রাজিলেও পেলে নাকি তেমন জনপ্রিয় নন, এমন এক হাওয়া অত্যন্ত সুকৌশলে বিশেষ বিশেষ
মিডিয়ার দৌলতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত। ব্রাজিল যাওয়ার সুবাদে সেই ভাবনা যে ঠিক
কতখানি অলীক, প্রমাণ পেয়েছিলাম। এবং এখন যখন ব্রাজিলীয় গ্রেটরা নিয়মিত আসছেন
আমাদের এই পোড়া দেশেও, বারবার শোনা ও দেখা যাচ্ছে, কীভাবে ‘আপন মনের মাধুরী’
মিশেয়ে এবং নিজ নিজ ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যসিদ্ধির কারণে উল্টোপথে চালিত করতে চেয়েছিলেন
বঙ্গজ ফুটবল মিডিয়ার সেই দিগগজরা!
কয়েকদিন আগেই পেলে এসে
বলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, এখনকার ব্রাজিলে ব্যক্তিদক্ষতার কমতি নেই, খামতি যা আছে
দলগত খেলায়। পেলে কি ঠিক বলেছিলেন, জানতে চাওয়ায় কার্লোস দ্বিধাহীন স্বরে
জানিয়ে গেলেন, ‘পেলে ফুটবলের রাজা। আর, রাজা কখনও ভুল হতে পারেন না। যা বলেছেন ওঁর
মত। তার মতের ওপর কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, চাইও না। নিশ্চয়ই ওঁর মনে হয়েছিল
তেমন। তাই বলেছিলেন। আমি আর কী বলতে পারি?’
ভবিষ্যতে পেলে-সম্পর্কিত
বাংলা কাগজের প্রতিবেদনে গুঁজে-দেওয়া বিশেষ মন্তব্যগুলো পড়ার সময় আর একবার আলাদা
করে ভেবে নেওয়া উচিত বোধহয় এবার!
No comments:
Post a Comment