ফুটবল-ইতিহাস পরিষ্কার
দু’ভাগে বিভক্ত। ক্রুয়েফের আগে, ক্রুয়েফের পরে! তাঁর মতো করে এমন প্রভাব রেখে যেতে
পারেননি আর কেউ, লিখলেন
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
Playing football is very simple, but playing simple football is the hardest
thing there is.
-
Johan Cruyff
প্রয়াত জোহান ক্রুয়েফকে সত্যিকারের শ্রদ্ধার্ঘ্য আলেখান্দ্রো
দিমারিয়ার। মুখে নয়, গোলমুখে; বলে নয়, গোলে! চিলের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনা যে-গোলে ১-১ করল,
ক্রুয়েফের নশ্বর শরীর নিঃশ্বাস নেওয়া থামিয়ে দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে।
বল পেয়েছিলেন বক্সে, ডানপায়ে। দিমারিয়া, সবাই জানেন,
বাঁপায়ের ফুটবলার। যেখানে পেয়েছিলেন, বক্সে ঠিক উল্টোপাশে এমন জায়গায় বল পেলে
লিওনেল মেসি বা আরিয়েন রবেনের বাঁ-পা ঝলসে ওঠে। দিমারিয়ার ডান পায়ে বিদ্যুৎ!
বার্সেলোনা ও চিলের গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো শরীর ছুঁড়েছিলেন ঠিকই। জেনেই যে, গোল
আটকাতে পারবেন না! তুলনায় যে-পায়ে জোর কম, দরকারে সেই পা-কেও কীভাবে ব্যবহার করতে
হয়, পায়ে-বলে দেখালেন দিমারিয়া।
ক্রুয়েফকে দু-পায়ের ফুটবলার গড়ে তুলেছিলেন আয়াক্সের জুনিয়র
দলের ট্রেনার জানি ফন ডার ফিন। সহজাত ডান পায়ের ফুটবলার হওয়া সত্ত্বেও তাই বাঁপায়ে
দুরন্ত শট নিতে পারতেন। পরে, কোচ হয়েও জোর দিতেন ফুটবলারদের কমজোরি পায়ের ব্যবহার বাড়ানোর দিকে। চমকে দিতেন বাঁপায়ের ফুটবলারদের ডানদিকে
খেলিয়ে, ডান পায়ের ফুটবলারদের বাঁদিকে। আজ মেসিকে মাঠের ডানদিকে এবং নেইমারকে
মাঠের বাঁদিকে খেলতে দেখতে অভ্যস্ত ফুটবল-বিশ্ব। শুরুটা করে গিয়েছিলেন ক্রুয়েফই।
নিজের ছেলে জোর্দি ডানপায়ের ফুটবলার বলে তাঁকে বাঁদিকে সরিয়ে আদ্যন্ত বাঁপায়ের
ফুটবলার স্তোইচকভকে খেলিয়েছিলেন ডানদিকে। বিপক্ষ বেঞ্চে অ্যালেক্স ফার্গুসনের
নাভিশ্বাস! ৪-০ জিতেছিল বার্সেলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোচের ধাঁধা লেগে
গিয়েছিল চোখে। পরে ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ফিরিয়ে এনেছিলেন ‘গুরু’-র কাছে শেখা সেই
কৌশল। রোনালদিনিওকে বাঁদিকে এনেছিলেন, মেসি তখন থেকেই ডানদিকে। ক্রুয়েফকে গালাগাল
দিতেও যে-মোরিনিওদের কখনও ভাবতে হয়নি দু-বার, সেই নিজ-মতে ‘স্পেশ্যাল’ কোচও সে-ধারণায়
প্রভাবিত হয়ে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে মাঠের বাঁদিকে এনে ফেলেছিলেন! ক্রিস্তিয়ানো
এখনও খেলেন বাঁদিকেই! ক্রুয়েফ যা করেছিলেন ১৯৯৪ সালে, আধুনিক ফুটবল সেই পথেই
হাঁটছে এই ২০১৬ সালেও, হুবহু। ‘সুদূরপ্রসারী প্রভাব’ সংজ্ঞা ও উদাহরণসহ!
এই ২০১৬-ই মাসখানেক আগে খুঁজে পেয়েছিল তাঁকে, মেসি আর
সুয়ারেজ যখন পেনাল্টিতে ‘ওয়ান-টু’ খেলেছিলেন! ক্রুয়েফ আর জেসপার ওলসেন এমনই
করেছিলেন ১৯৮২ সালে, আয়াক্সের হয়ে, হেলমন্ড স্পোর্ট-এর বিরুদ্ধে। হ্যাঁ,
ইন্টারনেটের যুগে জানা গিয়েছে, ক্রুয়েফও সেই কাজে প্রথম নন। কিন্তু, তিনি যে
সত্যিই প্রথম নন, এটা জানতেও তো ইউটিউব ভরসা! না হলে, বুকে হাত দিয়ে স্বীকার করবেন
কি কোনও ফুটবলপ্রেমী, রিক কোপেন্স আর মাইক ট্রেবিলককের নাম জানতেন তাঁরা,
মেসি-সুয়ারেজ ‘ট্যাপ পেনাল্টি’ নেওয়ার আগে? ক্রুয়েফের পেনাল্টির কথা অবশ্য জানতেন
তাঁরা, অনেকেই।
পেপ গারদিওলা যে অন্ধের মতো অনুসরণ করেন ক্রুয়েফকে, রোজ তা
পড়তে পারা যায় কোথাও না কোথাও, বিশেষত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাজার-এ। কিন্তু, ঠিক কোথায়
কোথায় এবং কীভাবে? না, তার ঠিকানা নেই!
‘কান্তেরা’ স্পেনীয় ভাষার শব্দ, বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় খাদ
বা খনি, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে আনতে হয়। বার্সেলোনায় এসে ক্রুয়েফ যে লা
মাসিয়ার পত্তন করে গিয়েছিলেন, এখন অনেকেই জানেন। কিন্তু, শুধু পত্তনে তো হবে না, দেখতে
তো হবে, কী কী তুলে আনা যায় সেই ‘কান্তেরা’ থেকে। রোনাল্ড কোয়েম্যান আহত, গিলারমো
আমোর কার্ড দেখে নির্বাসিত, কী করবেন ক্রুয়েফ? কাকে খেলাবেন তাঁর বড় সাধের সেই
জায়গায়, যেখান থেকে রক্ষণ আর আক্রমণের যোগসূত্র রক্ষা তো করতে হবেই, খেলাটাকেই
নিয়ন্ত্রণ করতে হবে অসামান্য দক্ষতায়? ‘কান্তেরা’ থেকে উঠিয়ে আনা হল পেপ গারদিওলা
নামের সেই না-কাটা হীরেটাকে। এবার কেটে পালিশ করে তাঁকে বার্সেলোনা ও স্পেনের
অধিনায়ক করে তোলার দায় সানন্দে কাঁধে নিলেন ক্রুয়েফ। অবিকল একই কাজ করেননি
গারদিওলা নিজেও? ইয়াইয়া তোরে তখন কাম্প নৌ-তে জায়গা তৈরি করে ফেলেছেন। পেপ এসে
ছেড়ে দিলেন তাঁকে। সবাই অবাক, আনকোরা কে এক সের্জিও বুসকেতস নাকি খেলবেন সেখানে!
পেপ বার্সেলোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৮-০৯ মরসুমে। আজ বার্সেলোনাকে ছেড়ে দিন,
স্পেনের মাঝমাঠও ভাবতে পারবেন না বুসকেতসকে ছাড়া! পরম্পরা নয়, শিক্ষা!
জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ আজও গারদিওলাকে সহ্য করতে পারেন না। সমালোচনাও
করেন না, পরিষ্কারই গাল পাড়েন বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে যে, ‘কোচ নয় ওই লোকটা দার্শনিক
হতে চেয়ে কী যে বলে মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারা যায় না!’ কারণ কী? সেই এক, কান্তেরা-র
মেসিকে বেশি ভালবাসা, ভালবেসে মেসিকে মাঝখানে নিয়ে এসে ইব্রাহিমোভিচকে উইংয়ে ঠেলে
দেওয়া। মনে পড়তে বাধ্য, গ্যারি লিনেকার নামের এক ফুটবলারের সঙ্গে ক্রুয়েফের
সম্পর্কের কথা, আজ ক্রুয়েফ প্রয়াত হওয়ার পর যিনি বলেছেন, তাঁর চেয়ে বড় কোচ কমই
দেখেছেন। সেই দিন কিন্তু লিনেকার বুঝেই উঠতে পারেননি, কেন তাঁকে মাঝখান থেকে
ডানদিকে সরিয়ে দেওয়া হল আর হুলিও সালিনাসকে টেনে আনা হল মাঝখানে। ‘ক্রুয়েফ যে
সিস্টেমের কথা বলেছিলেন, আমি হতে পারতাম আদর্শ সেন্টার ফরোয়ার্ড। কিন্তু, যাকে
পছন্দ নয়, ক্রুয়েফের ধরন ছিল ওভাবেই তাকে সরিয়ে দেওয়া। খেলা থেকে সরে থাকতে হচ্ছে
বলে আমি মাথা গরম করলে, সেই কাজে আরও সুবিধা ক্রুয়েফের। তাই-ই হল, আমি সরে
এসেছিলাম।’ ইব্রা-র লিনেকার সময় লিনেকারের
সঙ্গেই আরও এক ফরোয়ার্ডও বেরিয়ে এসেছিলেন, কারেসকা, যার সঙ্গে স্যামুয়েল এতো-র
তুলনা টানা যেতে পারে, গারদিওলার বার্সেলোনায়। তখন উঠে এসেছিলেন বোয়ান ক্রকিচ,
ক্রিস্তিয়ান তেয়ো-রা, একইভাবে, ‘কান্তেরা’ থেকে! শুধু তাই-ই নয়, পরে যেমন রোমারিও
এসে যোগ দিয়েছিলেন ক্রুয়েফের দলে, লুইস এনরিকের বার্সেলোনায় আজ নেইমারের পাশে
এসেছেন লুইস সুয়ারেজও!
খেলা বা খেলানোর ধরনে যাওয়া যাক, মিল যেখানে সবচেয়ে বেশি।
ক্রুয়েফের সিস্টেমটা ঠিক কী?
ক্রুয়েফ-সিস্টেম নির্ভরশীল গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারদের সুনির্দিষ্ট
ভূমিকার ওপর, যার মূলে থাকবেন সেন্ট্রাল-অ্যাক্সিস হিসাবে সেন্টার
ফরোয়ার্ড আর ‘ফ্রি’ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মধ্যে সম্পর্ক রাখার দায়িত্ব যাঁর।
মার্কো ফন বাস্তেন তাকেই বলতেন ‘অদৃশ্য সূতো’। এই চূড়ান্ত অক্ষে অন্য আরও যাদের
ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গোলরক্ষক আর দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। বাকি ফুটবলাররা প্রকৃত অর্থেই ‘ফ্রি’। তাদের মধ্যে দুজন উইঙ্গার, খেলবেন
টাচলাইন ধরে। রক্ষণের দুই সাইড ব্যাক ও মাঝমাঠের দুপাশে দুজন ক্রমাগত নজর রাখবেন
প্রান্ত ধরে দৌড়ে ওঠার দিকে, কখনও আবার বিপক্ষের প্রান্তিক দৌড় বন্ধ করার দিকে।
সার্বিকভাবে এই সিস্টেম দিয়েছিল আক্রমণে সারাক্ষণ ওঠার মানসিকতা, গতিময়তা, একই
সঙ্গে বল ধরে খেলে যাওয়ার শিক্ষা। ক্রুয়েফ যা বলতেন, লিও মেসির টুইটার-দল তাকে
তুলে ধরেছে, ‘মাঠে বল যেহেতু একটাই, নিজের দখলে রাখাটাই শ্রেয়।’
বার্সেলোনার ‘ড্রিম টিম’-এর খেলা যাঁরা দেখেননি, কিন্তু
গারদিওলা ও এনরিকের বার্সেলোনা এবং গারদিওলার বায়ার্ন মিউনিখকে যাঁরা দেখেছেন, বলে
বোঝানো জরুরি নয় যে, মিল ঠিক কতখানি এবং কোথায় কোথায়! জাভি এরনান্দেজ বার্সেলোনায়
ছিলেন মুখ্য সঞ্চালকের ভূমিকায়, এখন যা ইনিয়েস্তার দায়িত্বে। গোলরক্ষক হিসাবে
প্রথমে ভালদেস, পরে ব্রাভো বা টের স্টেজেন, বায়ার্নে নয়ার, আক্রমণ শুরুর ভূমিকায়।
লম্বা শটে বিপক্ষের বক্সে পাঠানোর অযথা অর্থহীন তাড়াহুড়ো নয়, হাত দিয়ে ছোট ছোট পাস
যেন, দুই স্টপারের কাউকে। স্টপার দুজন সরে যাচ্ছেন দুপাশে, উইংব্যাকদের সুযোগ
দিচ্ছেন ওপরে ওঠার, দুই উইংয়ে নেইমার-মেসি এখন বার্সেলোনায়, বায়ার্নে রবেন-রিবেরি
টাচলাইন ছেড়ে ভেতরে ঢোকেন তখনই যখন গোলর গন্ধ নিশ্চিতভাবেই পেয়ে গিয়েছেন। সেন্টার
ফরোয়ার্ড হিসাবে আগে মেসি ছিলেন, এখন সুয়ারেজ বার্সেলোনায়, বায়ার্নে লেওয়ানডোস্কি।
পেছন থেকে ঠিক যেমন ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করেছিলেন, মেসি বা মুলার চলে
আসছেন গোলের সামনে যখন, বিপক্ষ রক্ষণে ত্রাহি ত্রাহি রব। আর শুধু বার্সেলোনা বা
বায়ার্নই কেন, লরাঁ ব্লাঁ-র পিএসজি-কেও দেখুন না, একেবারে এক ছক। এই মুহূর্তে গোটা
বিশ্বে যে চারটি দল সত্যিই ভাল ফুটবল খেলছে, যাঁদের খেলা মানেই বলটাকে কোনও রকমে
লম্বা শট মেরে বিপক্ষের বক্সে বা তার আশেপাশে পাঠিয়ে দেওয়া নয় – সেই তিনটি দলই
অবিকল ক্রুয়েফ-সিস্টেম মেনে চলছে, খেলছে, আনন্দ দিচ্ছে দর্শকদের।
ক্রুয়েফ সম্পর্কে আলোচনায় রাইনাস মিশেলকে আসতেই হবে কারণ
তিনি ছিলেন ক্রুয়েফের গুরু। আর সেই আলোচনা এলেই যে শব্দবন্ধ বাংলা কাগজে উঠে আসে,
‘টোটাল ফুটবল’। সমস্যা হল, না মিশেল না ক্রুয়েফ, কেউ কখনও নিজেদের ফুটবল খেলার
ধরনকে ‘টোটাল’ বলেননি! মিশেল বরাবরই বলে এসেছেন, ‘প্রেসিং’। তাঁর আয়াক্সের খেলার
ধরন এক ফুটবল সাংবাদিককে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, তিনিই তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনে এই
‘টোটাল ফুটবল’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে প্রচলিত হয়ে
যায়। মিশেল পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘চেয়েছিলাম প্রেসিং ফুটবল। যেখানে বলের দখল হারানো
মাত্র ফুটবলাররা তাদের সামনের ফুটবলারদের ওপর প্রেস করবে, মানে চাপ দেবে, বলের দখল
ফেরত পেতে। তখন আক্রমণভাগের ফুটবলারকেও হয়ে যেতে হবে ডিফেন্ডার, যেহেতু সে বলটা
কেড়ে নিতে চাইছে।’ ফুটবলারদের সার্বিক দক্ষতা অবশ্যই বাড়াতে হত, সেই কারণেই মিশেল
ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলার ওপর কড়া নজর রাখতেন। ফুটবলারদের সবার শারীরিক দক্ষতা একটা
নির্দিষ্ট মানে না-পৌঁছলে এই খেলা ৯০ মিনিট ধরে খেলে যাওয়া, গোটা মরসুম জুড়ে খেলে
যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে, প্রাক-মরসুম অনুশীলন খুব গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে মরসুম জুড়ে
একইভাবে খেলে যাওয়ার জন্য রোটেশনও গুরুত্বপূর্ণ। নিউক্লিয়াস চিহ্নিত করা এব তাদের
ধরে রাখা। বেশ কঠিন কাজ। এই তীব্রতা ৫০-৫৫ ম্যাচের মরসুম জুড়ে দেখিয়ে যাওয়া
পারফরম্যান্সে, প্রায় অসম্ভব স্তরের কাজ। যাঁরা করতে পারেন, ফুটবল তাঁদের জন্য
সত্যিই সুন্দর। বাকিরা ওড়াবেন!
ক্রুয়েফের জীবন তবুও শুধুই প্রাপ্তির খাতায় উপচে-পড়ার
ইতিহাস নয়। নিজের দল, আয়াক্স আমস্টারডম ও সেই দলের সতীর্থরা সবাই মিলে তাঁর হাত
থেকে অধিনায়কত্ব নিয়ে নেওয়ার দাবিতে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। সেই সময় ক্রুয়েফ
মানে আয়াক্সকে তিনবার ইউরোপ-সেরা করেছেন, তারপরও! তাঁর নামে উঠেছিল ‘বড্ড বেশি
টাকা চেনেন’ এই অভিযোগও। বার্সেলোনায় এসে প্রথম মরসুমে দুরন্ত সাফল্য, রেয়াল
মাদ্রিদকে ৫-০ হারানোর পরের তিন বছরে আর মাত্র একটি ট্রফিই দিতে পেরেছিলেন।
নেদারল্যান্ডস-এর হয়ে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানদের অপদস্থ করতে গিয়ে আরও বেশি
গোল না দিতে পেরে শেষে নিজেদেরই হার। বার্সেলোনায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে এসি
মিলানের কাছে ০-৪। শেষে বার্সেলোনা থেকেই কোচ হিসাবে শেষ দু-বছরে ট্রফি দিতে
না-পেরে হতাশাজনক বিদায়। ক্রুয়েফের জীবনেও অপ্রাপ্তি কিছু কম নয়।
কিন্তু, ট্রফির সাফল্য মরসুম শেষে আর ইতিহাস বইতে থাকে। যা
থেকে যায়, অবিশ্বাস্য প্রভাব। পরের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারা সৃষ্টিশীলতায়,
সৌন্দর্যে। তাঁর পর গারদিওলা এবং এনরিকে ছাড়া আর কোনও ফুটবলার ক্লাব কোচিংয়ে এসে
এত সাফল্য পাননি। এবং তাঁর এই দুই ছাত্রও সবে শুরু করেছেন বলাটাই ঠিক যেমন,
ফুটবলার হিসাবে তাঁরা কেউই ক্রুয়েফের দশ মাইলের মধ্যে আসারও যোগ্য নন, নিজেরাই
জানেন। প্রথম ‘ইউরোপীয়’ ফুটবলার হিসাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তারকা, ক্রমশ বিশ্বেও। কোচ
হয়ে ক্লাব ফুটবলে প্রতি সপ্তাহে নিংড়ে-নেওয়া চাপ নিরন্তর সহ্য করেননি
বেকেনবাওয়ারও। আবার ফুটবলার হিসাবে পেলে বা মারাদোনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়নি
কোনও নির্দিষ্ট শব্দ, যেভাবে হয়েছে ‘ক্রুয়েফস টার্ন’।
ওয়ার্ল্ড সকার একবার ফুটবল ইতিহাসের সেরা কুড়ি দল বেছে
নিয়েছিল। একমাত্র ফুটবলার ও কোচ হিসাবে ক্রুয়েফের তিনটি দল ছিল সেই সেরা তালিকায়।
১৯৭৪-এর নেদারল্যান্ডস, ১৯৭১-৭৩ আয়াক্স আমস্টারডম ও বার্সেলোনার স্বপ্নের দল।
পেলের ১৯৭০ ব্রাজিল ও ১৯৫৮ ব্রাজিল ছিল, কিন্তু, তৃতীয় কোনও দল জায়গা পায়নি সেই
তালিকায়।
সবাই খেলেন। তারপর আসেন
জোহান ক্রুয়েফ। খেলাটাই পাল্টে যায়!
ফুটবল-ইতিহাস পরিষ্কার
দু’ভাগে বিভক্ত। ক্রুয়েফের আগে, ক্রুয়েফের পরে! তাঁর মতো করে এমন প্রভাব রেখে যেতে
পারেননি আর কেউ।
এক এবং অনন্য ছিলেন, থেকেই যাবেন ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’ জোহান
ক্রুয়েফ!
No comments:
Post a Comment