Tuesday, July 8, 2025

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / ‘সোজা মানুষ নও’!

 এঁকেছিলেন দেবব্রত ঘোষ

তাই তো দেশের, এমনকি রাজ্যের মানুষও চিনতে পারে না সৌরভ গাঙ্গুলিকে, অনাবশ্যক বিতর্ক খোঁজে, সোনা ফেলে দিয়ে...

‘তুমি তো আমাদের মতো সোজা মানুষ নও’।

পথের দাবী–র নায়কের উদ্দেশে লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সময়, পরিপ্রেক্ষিত একবারে আলাদা। কিন্তু, আজকের নায়কের জন্যও প্রাসঙ্গিকতায় একশোয় একশো। ‘তাই তো দেশের খেয়াতরী তোমায় বহিতে পারে না!’

তর্ক অনেক রকম, বিতর্ক সবার জন্য নয়। বিতর্কের অাঁচে পুড়ে প্রতিভার সোনা আরও খাঁটি হয়। অনেকে বিতর্ককে এত গুরুত্ব দেন যে বিতর্ক থেকে দূরে সরে–‌থাকাকেই জীবনের উদ্দেশ্য মেনে নেন। স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয় তাতে, মন খুলে কথা বলারও জো থাকে না, কারণ, কোথায় কীভাবে বিতর্কের ফাঁদ পেতে রেখেছে ভুবন, তাঁরা সন্দিহান। আমাদের মতো একেবারে সাধারণ, পিএফ–গ্র‌্যাচুইটি নির্ভর জীবন। একটু এপাশ–ওপাশ হওয়ার জো নেই। যদি ‘বস্‌’ মানে ‘জনতা’ চটে যায় বা কর্তার মনে ব্যথা দিয়ে ফেলেন। তাঁদের পিএফ–গ্র‌্যাচুইটি তাঁদের অর্জিত খ্যাতি যাতে বিতর্কের দাগের লেশ নেই। এবং তেমন না–হওয়াই না কি আদর্শ!

সৌরভ গাঙ্গুলিকে তেমন অ–স্বাভাবিক হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি, দিলেও তাঁর তাতে ‘থোড়াই কেয়ার’। তিনি কাজ করতে এসেছিলেন, কাজ করেছেন। কে কী ভাবল বা বলল, বয়েই গেল। তাই তিনি মনুষ্যোচিত, কুলুঙ্গিস্থিত নন। তাঁর সম্পর্কে শুধুই ভাল–ভাল কথা প্রচারিত হবে, এমন দাবিতে তিনি কখনও সোচ্চার নন। সমালোচিত হওয়ার ভয়ে তিনি পিছিয়ে আসেননি কখনও, দলের ভালর জন্য নিজে নির্বাসিত হতেও দ্বিধা করেননি। আর, বিশ্বের সেরা অধিনায়কদের বিশ্ব দেখছে, নিজের নির্বাসন রুখতে টেস্টজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সিরিজে সমতা ফেরানোর সম্ভাবনাকেও বলি দিতে। নিজের অর্জিত খ্যাতিতে নির্বাসনের কালো দাগ লাগানোয় কী তীব্র অনীহা তাঁদের!‌ দলের আগে নিজেকে স্থাপনের প্রচেষ্টাও এত পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়নি কখনও সাধারণের চোখে। তাই, সৌরভের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য এত বিরাট হয়ে দাঁড়ায়, শেষ বিচারে।


তাঁর কাজে বাধা এলে নিজে সরিয়ে দিতেন। তাঁর ভাবনা অনুযায়ী কেউ চলতে না–চাইলে তাঁকে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে শেষে বাধ্যই করতেন তাঁর ভাবনা মেনে চলতে। রাহুল দ্রাবিড়কেই ভাবুন। উইকেটরক্ষক করেছিলেন, গোটা ২০০৩ বিশ্বকাপ জুড়ে ‘ওঠবোস্‌’ করিয়ে ছিলেন বলে নিজে অধিনায়ক হয়ে প্রথম সুযোগেই ছেঁটে ফেলেছিলেন সৌরভকে। অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে সৌরভ সম্পর্কে নিজের মনোভাব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতেও ছাড়েননি। তাঁকে সৌরভ ওপেনার করলেই অফস্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে চলে–আসা আর পাকিস্তানে প্রথমে সৌরভকে শুরুতেই শোয়েবদের মুখে ছেড়ে দেবেন বলে ওপেনার হওয়ার প্রস্তাব এবং পরে উইকেটের চরিত্র দেখে ‘সৌরভ নেমে রান করে দিলে আর কখনও বাদ দেওয়া যাবে না’ ভেবে নিজে নেমে শেহবাগের সঙ্গে পঙ্কজ রায়–ভিনু মানকড়ের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে–যাওয়া — এমন বিদ্যাসাগরী ‘সুবোধ’ ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা অনেক দিন ধরেই দেখেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে এমন মানসিকতারই জয়জয়কার, যা শুধু নিজেদের দিকে তাকাতে বলে, তাকাতে বলে নিজের অঞ্চলের দিকে। এই দুই–এর বাইরে দৃষ্টি দেওয়া মানেই ভারতীয় ক্রিকেট–কর্তাদের চক্ষুশূল। রাহুল তাকাননি, তাঁর ঠিক আগের জন ছাড়া আগেও আর কখনও কেউ তাকাতেই চাননি এই দিকে। ‘বৃহত্তর পরিমণ্ডল’, ‘বৃহত্তর স্বার্থ’, তাঁদের কথায় এসেছিল আরও অনেক রকমে, সেই সব বাক্যের স্থান ইংরেজি মিডিয়ার ইতিহাসে উজ্জ্বল। কিন্তু, কাজে কখনও করে দেখাননি কেউ। সৌরভ করতে গিয়েছিলেন বলেই সমস্যা এবং বিতর্ক।

তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন। তিনি দলে এলেন, প্রশ্ন। তিনি সেঞ্চুরি করলেন, প্রশ্ন। তিনি দলে থাকলেন, প্রশ্ন। তিনি অধিনায়ক হলেন, প্রশ্ন। তিনি সেরা অধিনায়ক হলেন, তা–ও প্রশ্ন। তিনি বিশ্বকাপ ফাইনালে তুললেন, প্রশ্ন। তিনি যুবরাজ সিংকে পছন্দ করেন, প্রশ্ন। তিনি জাহির খানকে দলে রাখতে চান, প্রশ্ন। তিনি হরভজন সিংকে ভারতের সেরা অফস্পিনার ভাবেন, প্রশ্ন। তিনি অনিল কুম্বলেকে ভারতের সর্বকালের সেরা ম্যাচ–জেতানো বোলারের সম্মান দেন, প্রশ্ন। তিনি সেঞ্চুরি করেন, দল বিদেশে টেস্ট সিরিজ জেতে, প্রশ্ন। সেই তিনি জামা ঘোরালে বা অস্ট্রেলিয়াকেও অন্যান্য দেশের মতো দেখেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে নন, প্রশ্ন। তিনি দলে থাকবেন কেন, প্রশ্ন। কার জায়গায় দলে আসবেন, প্রশ্ন। কেন খেলে যাবেন, প্রশ্ন। এমনকি, এখন যখন অবসর নিয়ে ফেলেছেন তখনও প্রশ্ন!

এবং সেই সব প্রশ্ন তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমরা বাঙালিরাও একেবারে সামনের সারিতেই, বরাবর। তাঁর ক্রিকেটীয় দক্ষতায় আমাদেরই কখনও বিশ্বাস ছিল না, তাই বারবার আমরা বলে এসেছি, তাঁকে ‘দলে–ঢোকানো’ হয়েছে, তাঁকে নেতৃত্ব ‘পাইয়ে–দেওয়া’ হয়েছে, তাঁর দক্ষতা বিন্দুমাত্রও ছিল না, কেউ কেউ ছিলেন বলেই তিনি খেলে যেতে এবং নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পেরেছিলেন এত দিন ধরে।

আর কৃতজ্ঞতারও তো শেষ নেই, কতজনের কাছে যে সারা জীবন ধরে কৃতজ্ঞ থেকেই যেতে হবে সৌরভকে, সেই তালিকাও অন্তহীন। একবার চোখ বুলিয়ে নিন —

টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য চিরকৃতজ্ঞ জগমোহন ডালমিয়ার কাছে।

টেস্টের প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ নভজ্যোৎ সিং সিধুর কাছে। এবং, সেই একই কারণে কৃতজ্ঞ অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন এবং কোচ সন্দীপ পাটিলের কাছে। কেন? প্যাড পরে বসেছিলেন সিধু। হেঁ হেঁ করে হেসে পাটিল জানতে চেয়েছিলেন আজহারের কাছে, সর্দারটা এমন বুদ্ধু যে টিম–লিস্টও দেখে না? অসমর্থিত সেই গল্পের প্রত্যক্ষ প্রভাব, অপমানিত সর্দার প্যাড খুলে সাজঘর থেকে বেরিয়ে হোটেল হয়ে সোজা বিমানবন্দরে এবং বিমান ধরে ভারতে! জায়গা খালি ভারতের মিডল–অর্ডারে, সুতরাং, সফরে আগের ম্যাচগুলোয় মোটামুটি রান–পাওয়া সৌরভের জায়গা হল। কৃতজ্ঞ থাকবেন না পাটিল এবং আজহারের কাছে? এ আবার কেমন কথা!


সেই আজহারের কাছেই কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, তিন নম্বরে তাঁকে পাঠানোর জন্যও! শতরান পেয়েছিলেন, কিন্তু, আজহারের আগে বাংলার অধিনায়কও যে তাঁকে কখনও তিনে পাঠাননি! আসলে যে, তিনে পাঠিয়ে ব্যর্থ হলেই আবার ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মানসিকতা থেকেই তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ব্যাটিং–অর্ডারে অত ওপরে, তাতে কী এসে গেল? পাঠিয়ে তো ছিলেন আজহার! তাই, কৃতজ্ঞ থাকবেন না?

চোট পেলেন শ্রীনাথের স্ট্রেট–ড্রাইভে, নেটে বল করার সময়। বাইরে দলের। ফিরে এসে দেখলেন, যে তিন নম্বরে তাঁর জায়গা নিয়ে কোনও কথা হওয়ার জায়গাই ছিল না, সেখানে দক্ষিণী এক ব্যাটসম্যানকে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং পারফর্ম না–করা সত্ত্বেও তাঁকেই রেখে দেওয়া হচ্ছে সেখানে, আর সৌরভকে ব্যাট করতে নামতে হচ্ছে পাঁচ বা ছয়ে। ওই তিন নম্বরে খেললে তাঁর টেকনিকের খুঁতাবলী জনসমক্ষে আরও বেশি করে তুলে ধরার সুযোগ পাওয়া থেকে সমালোচকদের বঞ্চিত করার জন্যও কি আজহারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল না সৌরভের?

শচীন তেন্ডুলকারের কাছে এমনিতেই অনেক কৃতজ্ঞতা। কিন্তু, পরপর পাঁচটা টেস্ট হেরে শচীন যদি বীতশ্রদ্ধ না–হয়ে দায়িত্ব না–ছাড়তেন, কী করে সৌরভ আসতেন নেতৃত্বে? শচীনকে এই সিদ্ধান্ত নিতে যাঁরা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যেও শীর্ষে থাকবে আজহারেরই নাম। আর, ম্যাচ–গড়াপেটা বিতর্ক। ওই বিতর্ক না–থাকলে শচীনের ভারত টানা পাঁচ টেস্ট হারত না, শচীনও দায়িত্ব ছাড়তেন না, সৌরভও পেতেন না ভারতের অধিনায়কত্ব। তাই, ম্যাচ–গড়াপেটা বিতর্কের প্রতিও চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত সৌরভের, বিশেষত আজহারের কাছে, তাই না?

যেমন বাঙালির আরও এক প্রিয় বিষয়, সৌরভের নেতৃত্ব এত ভাল হয়ে দেখাত না রাহুল–শচীন–হরভজন–কুম্বলে–লক্ষ্মণরা এত ভাল যদি না–খেলতেন। সোজা বাংলায়, সৌরভের কোনও কৃতিত্বই নেই, নেহাত ওঁরা ভাল খেলেছিলেন বলেই নেতা সৌরভের রেকর্ড এত ভাল! মার্শাল–হোল্ডিং–গারনার–রবার্টসরা ছিলেন বল হাতে, ব্যাট হাতে রিচার্ডস–গ্রিনিজ–হেনেস–লয়েড, উইকেটের পেছনে ডুজন, এমন দল সফল হলে লয়েডের কৃতিত্ব আর এমন কী? ম্যাকগ্রাথ–ওয়ার্নের হাতে সমস্যায় পড়লেই বল তুলে দাও, হেডেন–ল্যাঙ্গার–পন্টিং–মার্ক ওয়া–ড্যামিয়েন মার্টিন–গিলক্রিস্ট আছেন দলে, স্টিভের আর কৃতিত্ব কী? দুর্ভাগ্যবশত, এই কথাগুলো লয়েড সম্পর্কে কখনও কখনও বলা হলেও স্টিভ সম্পর্কে কোনও দিনই বলা হয় না! লয়েডেরও চামড়ার রঙ কালো, স্টিভ শ্বেতাঙ্গ সমাজের প্রতিভূ, ওঁর সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না কখনও! কিন্তু, সৌরভের আবার কৃতিত্ব কীসের, বাকিদেরই কৃতিত্ব ওঁর মতো চির–অনুপযুক্ত অধিনায়ককে এমন ‘নেতৃত্বের জন্যই জন্ম’ মনে–হওয়ার পেছনে, বাঙালি খুব ভাল করে জানে!

যেমন গ্রেগ চ্যাপেল–কিরণ মোরে–রাহুল দ্রাবিড় ত্রিভুজ। ওই ত্রিভুজই বাদ দিয়েছিল বিদেশে সিরিজ জিতে–আসা অধিনায়ককে। এক বছর আবার আবর্জনায়। সেখান থেকে ফিরলেন, সবার প্রত্যাশার সীমানা ছাড়িয়ে। এমন ফিরলেন, ফিরে–আসার পর তাঁর থেকে সফল আর কেউ নয় — না একদিনের ক্রিকেটে, না টেস্টে। এই সাফল্যের কৃতিত্ব তা হলে কার? অবশ্যই গ্রেগ চ্যাপেলের, অবশ্যই মোরের, অবশ্যই দ্রাবিড়ের — তাই না? সৌরভের এই ন্যূনতম সৌজন্যবোধটুকুও নেই, প্রশ্ন উঠল, উঠছে, উঠবে! থাকলে, সবার আগে গ্রেগের ওই শ্বেতরঙা শ্রীচরণে মাথা নুইয়ে এই সাফল্য তাঁকে উৎসর্গ করতেন না? গ্রেগ না–থাকলে এই সৌরভ কোথায়? ঠিক যেমন, ডালমিয়া না–থাকলে এই সৌরভ কোথায়!

লোভ সামলানো কঠিন। চলুন, সেই শরৎচন্দ্রের কাছেই হাত পাতি আমরা, সব্যসাচী সম্পর্কে যেখানে লিখেছিলেন —

‘তুমি দেশের জন্য সমস্ত দিয়াছ, তাই তো দেশের খেয়াতরী তোমায় বহিতে পারে না, সাঁতার দিয়া তোমাকে পদ্মা পার হইতে হয়; তাই তো দেশের রাজপথ তোমার কাছে রুদ্ধ, দুর্গম পাহাড়–পর্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়; — কোন্‌ বিস্তৃত অতীতে তোমারি জন্য তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল, কারাগার সে তো শুধু তোমাকে মনে করিয়াই প্রথম নির্মিত হইয়াছিল — সেই তো তোমার গৌরব। তোমাকে অবহেলা করিবে সাধ্য কার! দুঃখের দুঃসহ গুরুভার বহিতে তুমি পারো বলিয়াই তো ভগবান এত বড় বোঝা তোমারই স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছেন! মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের হে রাজবিদ্রোহী! তোমাকে শতকোটি নমস্কার!’

কী বলছেন, শরৎচন্দ্র চিনতেন না সৌরভকে? মানছি না, মানব না!


*‌ প্রকাশিত — খেলা, ১৬ নভেম্বর ২০০৮

** আজ ৮ জুলাই ২০২৫, সৌরভ গাঙ্গুলি ৫৩

Thursday, June 26, 2025

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / নীল চোখ, নীল জার্সির ‘রোজোনেরি’-কে জন্মদিনে পাতা উল্টে দেখা, ভালবাসায় …

 


** আজ ২৬ জুন তিনি ৫৭

সুভাষ ভৌমিক বলতেন, ভারতীয় ফুটবলে রাইট ব্যাকের জায়গায় সুধীর কর্মকারের মূর্তি বসানো উচিত। বিশ্ব ফুটবলে লেফট ব্যাকের জায়গায় ঠিক তেমনভাবেই থাকা উচিত যাঁর মূর্তি তাঁর নাম পাওলো মালদিনি!

ফুটবল ইতিহাসে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জিয়াসিনতো ফাচেত্তি। কাতেনাচ্চিওর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যিনি ছিলেন মালদিনির চিরশত্রু শিবির ইন্তার মিলানে, আর্জেন্তিনীয় কোচ এলেনিও এরেরার অন্যতম সেরা অস্ত্র হিসাবে, নীল-কালো জার্সিতে। ট্রফির হিসাবে ফাচেত্তি এগিয়ে ১৯৬৮- ইউরো জয়ের কারণে। বিশ্বকাপ ফাইনালে দুজনেই হেরেছিলেন ব্রাজিলের কাছে সত্তরের মেহিকোয় পেলের ব্রাজিল উড়িয়ে দিয়েছিল ফাচেত্তির ইতালিকে -, মালদিনির ইতালিকে হারাতে অবশ্য বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথম টাইব্রেকারের সাহায্য নিতে হয়েছিল রোমারিও-বেবেতোর ব্রাজিলকে, ১৯৯৪ সালে।

দুই মিলানের শত্রুতা এমন, মিলান শহরে যে স্টেডিয়াম তাদের ঘরবাড়ি, নামটাও পাল্টে ডাকেন দুদলের সমর্থকরা এসি মিলান, আসলে যাদের মালিকানা ছিল, বলেন সান সিরো; ইন্তার, পরে যারা ভাড়াটে হিসাবে এসেছিল শুরুতে, বুক ফুলিয়ে ডাকে জিউসেপ্পে মিয়াজা। তবুও, এই ইতিহাসে বিরোধিতা যতটা, খুব কমই থাকে ফাচেত্তি-মালদিনি প্রশ্নে।

কারণটা বলে গিয়েছিলেন ফাচেত্তি, তাঁর অমর মন্তব্যে। ইতালীয় ফুটবলে আমার জায়গায় কে? মালদিনিকে দেখার পর এই প্রশ্নটাই অর্থহীন। পাওলোর একটাই সমস্যা, চিরকাল খেলল এসি মিলানের হয়ে!

রোবের্তো কার্লোস এসেছিলেন। ফ্রি কিক থেকে গোলগুলোর জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ কখনও কখনও তাঁর নামও এনেছেন আলোচনায়। কিন্তু, লেফট ব্যাকের প্রাথমিক কাজ রক্ষণ মাথায় রাখলে কার্লোস কোথায়? তিনি যে তখন নিজের রক্ষণে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন জিনেদিন জিদানের পাস কী করে থিয়েরি অঁরি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে গোল করে যাচ্ছেন!

ইতালির রক্ষণভাগের ফুটবলারদের সম্পর্কে একেবারেই অযৌক্তিক কিছু ধারণা সুপ্রচলিত বাংলায়। বাজারি সংবাদমাধ্যমের কারণে তা পল্লবিতও হয়ে উঠেছে গত বছর চল্লিশে। যাঁরা এমন ধ্যানধারণার কল্পজগতে বসবাস করেন তাঁরা জেনে কী বলবেন যদিও জানা নেই, তবু, লেখা উচিত ফাচেত্তি ১৮ বছরের ফুটবল-জীবনে লাল কার্ড দেখেছিলেন একবার; কুড়ি বছরে দুবার দেখেছিলেন ফ্রাঙ্কো বারেসি; ২৫ বছরে তিনবার সেই দুর্ভাগ্য হয়েছিল মালদিনির। এর চেয়ে পরিষ্কার করে আর কোনওভাবেই বোঝানো যায় না মারি অরি পারি যে কৌশলে অস্ত্রে আর যা- থাকুক মার ছিল না মালদিনিদের তূণে, কখনও।

পড়ে আবার চমকে উঠবেন না, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেফট ব্যাকের জীবন শুরু হয়েছিল এসি মিলানে, রাইট ব্যাক হিসাবে!

এখানে কারণ মাওরো তাসোত্তি। মধ্যগগনে তখন, কী করে নবাগত কাউকে তাসোত্তির জায়গায় খেলানো সম্ভব? মিলানের দায়িত্বে তখন নিলস লিয়েডহোম। পরামর্শ দিয়েছিলেন ষোলর মালদিনিকে ডানদিকে শুরুটা তো কর, দেখছি তারপর আটের দশকের মাঝামাঝি সেই সময় মালদিনি তখন ডানপায়ের ফুটবলার। ক্রমশ বুঝতে পারেন, রক্ষণে নিজেকে আরও উন্নত করতে বাঁপায়েও সমান কুশলী হয়ে উঠতে হবে। শুরু সেই সাধনা, যার শেষ শ্রেষ্ঠ আসনে বসে। এমন উত্তরণও কি আর দেখেছে ফুটবল ইতিহাস?

মালদিনি আসলে শুরু থেকেই বিচরণ করেছেন সর্বোচ্চ স্তরে, সুপারলেটিভ বারেসি, কোস্তাকুর্তাদের পাশে নিজেকে চিনিয়েছেন। পরের কানাভারো-নেস্তারা উঠে এসেছেন তাঁকে সামনে রেখে। মারাদোনা, জিদান, রোনালদোর বিরুদ্ধে খেলেছেন অকুতোভয়। এমনকি, ক্রিস্তিয়ানোর বিরুদ্ধেও। শুধু, খেলা হয়নি মেসির বিপক্ষে। প্রশ্নকর্তা শুনে বলে ফেলেছিলেন মেসির সৌভাগ্য সঙ্গে সঙ্গেই কারেকশন করে দিয়েছিলেন মালদিনি, না, আমার সৌভাগ্য!

ইল কাপিতানো মালদিনি এবং তাঁর ইতালি সম্পর্কে ভাবতে গেলেই মনে পড়ে যায় স্টেফান এডবার্গকে, আর মাইকেল স্টিচের বিরুদ্ধে উইম্বলডনে সেই ম্যাচটা। সেই ১৯৯১ সেমিফাইনালে এডবার্গ হেরেছিলেন , , , ৭। সার্ভিসব্রেক একবারই হয়েছিল। স্টিচের সার্ভিস ভেঙেছিলেন আগের বারের চ্যাম্পিয়ন এডবার্গ। সুইডিশ এডবার্গের সার্ভিস অবশ্য একবারও ব্রেক হয়নি তেইশটি গেমে। উইম্বলডনে পুরুষদের সিঙ্গলস সেমিফাইনালে একবারও সার্ভিস গেম নাহারিয়ে ম্যাচ হেরে যাওয়ার একমাত্র দৃষ্টান্ত।

মালদিনির ইতালি দেখুন। ১৯৯০ বিশ্বকাপ নিজেদের দেশে। সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনার সের্জিও গোয়কোয়চিয়ার হাতে আটকে বিদায়। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হার ব্রাজিলের কাছে, যেখানে রোবের্তো বাজ্জিওর শেষ পেনাল্টিমিস এখন বিশ্বকাপের বিষাদগাথায়। ২০০২ বিশ্বকাপের প্রথম ১৬য় অন্যতম আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হার সোনালি গোলে। ঠিক যেমন ২০০০ ইউরো ফাইনালে ফ্রান্সের দাভিদ ত্রেজেগুয়ের সোনালি গোল, আবার।

টাইব্রেকারে যে দুটি ম্যাচে হার, ফিফার রেকর্ড বলছে, ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর ১৯৯৪ ফাইনালের ফল ড্র। কারণ, টাই ভেঙে ম্যাচের ফয়সালা হলেও ফিফার খাতায় সেই ম্যাচ অমীমাংসিতই থেকে যায়। কিন্তু, দেশের হয়ে বিশ্বকাপ তো দূরের কথা, কোনও ট্রফিই ওঠেনি মালদিনির হাতে!

এডবার্গের বিস্ময় যেমন, একবারও সার্ভিস নাখুইয়ে হেরে গেলাম, প্রথম দুটি বিশ্বকাপের পর মালদিনির বিস্ময়ও একইরকম, হারিনি, সাতটা করেই ম্যাচ খেলেছি, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন নই!

এমনকি, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে শুরুর মিনিটে গোল পেয়েও নির্ধারিত সময়ের খেলাশেষে - ছিল ম্যাচ, পরে টাই ভেঙে স্টিভেন জেরার্ডরা ট্রফি নিয়ে গিয়েছিলেন কামাল আতাতুর্ক স্টেডিয়াম থেকে। কিন্তু, টাইব্রেকারের কারণেই সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফল, এখনও বলছে, অমীমাংসিত!


আক্ষেপ
নেই রোজোনেরি মালদিনির তবুও। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে তিনি একক্লাবের ফুটবলার জীবনে এসি মিলান ছাড়া আর কোনও ক্লাবের হয়ে খেলেননি। বাংলার একক্লাবের ফুটবলারদের সঙ্গে মেলাতে চাইলে গুলিয়ে যাবে। কলকাতায় জীবনের শুরু থেকে শেষ একই ক্লাবে অসম্ভব, কারণ, বড় ক্লাবের ছোটদের দল থাকে না এখানে। আজীবন মোহনবাগান যাঁরা, সিনিয়র স্তরে পৌঁছনো এবং মোহনবাগানে সইয়ের পর, আর কখনও সবুজমেরুন তাঁবুর বাইরে বেরননি। যেমন কলকাতা মাঠে সুব্রত ভট্টাচার্যের শুরু বালি প্রতিভায়, পরে বিএনআর হয়ে মোহনবাগান এবং শেষ করেছিলেন সবুজমেরুন জার্সিতেই। মালদিনির ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ লালকালো, কোনও বালি প্রতিভা নেই তাঁর জীবনে। ১৯৬৮ সালে জন্মে ১৯৭৮এর শুরুর আগে পর্যন্ত ফুটবল খেলেছিলেন শুধুই রাস্তায়। এসি মিলান ইউথ অ্যাকাডেমিতে সেই যে ১৯৭৮ সালে নাম লিখিয়েছিলেন, ৩১ মে ২০০৯, ফিওরেন্তিনার বিরুদ্ধে জিতে ফুটবলার জীবনকে আলবিদা জানানোর সময় পর্যন্ত, তিনি শুধুই এসি মিলানের।

কোচ হবেন না, জানিয়ে দিয়েছিলেন অবসর নেওয়ার সময়। প্রাক্তন কোচ কার্লো আনচেলোত্তি যখন চেলসির দায়িত্ব নিয়েছিলেন, মালদিনিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর সহকারী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে। সরকারি বক্তব্য পাওয়া যায়নি, কিন্তু মালদিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণও করেননি। হয়ত নয়, নিশ্চিতই জানিয়েছিলেন, অন্য কোনও ক্লাবের জার্সিতে থাকব না বলেই তো কোচিং নাকরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম!

পাঁচবার ইউরোপসেরা আর সাতবার স্কুদেতো ছাড়াও এসি মিলান তাঁকে যা দিয়েছে তিন নম্বর জার্সি। তাঁর অবসরের পর ঘোষণা করেছিল, মিলানে লালকালো তিন নম্বর জার্সি আর কারও পিঠে থাকবে না। পরে, ঠিক হয়, পাওলোর ছেলেদের মধ্যে কেউ যদি মিলানের জার্সি পরার যোগ্যতার্জন করে, দেওয়া হতে পারে। না হলে সেই তিন নম্বর জার্সি চিরতরে অবসরে। নিয়ম মেনে গত ১৬ বছরে তাই আর কারও পিঠে দেখা যায়নি লাল-কালো তিন।



অবসর নেওয়ার বছর দুই আগের ঘটনা। এসি মিলান খেলছিল বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে। খেলাটা দেখেছিলেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।পরে প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ৯০ মিনিট মাঠে ছিল, একবারও ট্যাকল করতে দেখিনি। ডিফেন্ডার হিসাবে কোন সারিতে ওঁর উপস্থিতি বোঝাতে যথেষ্ট।

ট্যাকলে গেলে বল নিয়েই ছাড়তেন সাধারণত। তবু, ট্যাকল সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, যদি ট্যাকলে যেতেই হয়,বুঝতে পারি, আগেই আমি পরাজিত, তাই না?

সেবাস্তিয়ান রোসি, দিদা বা জিয়ানলুকা পাগলিউকা, যাঁরা ছিলেন মালদিনের পেছনে তিনকঠির তলায়, জানতেন, পূর্বানুমান ক্ষমতার সদ্ব্যবহারে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় হাজির থাকাই ডিফেন্ডারের সবচেয়ে বড় কাজ। যে ডিফেন্ডারকে বারবার ট্যাকলের কড়া রাস্তায় যেতে হয় সে আবার ডিফেন্ডার কেন! আর সেই কারণেই তো নাইকি- সেই বিজ্ঞাপনটা যেখানে মালদিনির ছবি দিয়ে বলা হয়েছিল ইতালির গোলরক্ষক হওয়াটাই সবচেয়ে সহজ কাজ ইউরোপে

মালদিনি যে সেই ডিফেন্ডার, যাঁর অভিধানে কড়া ট্যাকল নেহাৎ অপ্রয়োজনীয়। তাই সেই ফুটবলারকে মনে পড়লেও 'অকারণ হরষ!