২৪ পাসের সুয়ারেজ-গোল, সৌজন্য, @OptaJose |
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
বার্সেলোনা – ৪ রেয়াল
মাদ্রিদ – ০
(সুয়ারেজ ১১, ৭৪, নেইমার ৩৯, ইনিয়েস্তা ৫৩)
খুয়ানদে রামোস ছিলেন রেয়াল মাদ্রিদের দায়িত্বে।
বিপক্ষে পেপ গারদিওলার বার্সেলোনা। ২০০৯ লা লিগায় সেই ম্যাচেই শেষবার এল ক্লাসিকোয়
যুযুধান দুই শিবিরের দায়িত্বে দুই স্পেনীয়। যদিও এই পরিচয়ে খুশি হওয়ার কোনও কারণই
খুঁজে পাবেন না আজন্ম-কাতালান গারদিওলা। সেই ম্যাচে বার্সেলোনা এভাবেই গুঁড়িয়ে
গিয়েছিল রেয়ালকে, ৬-২। আবার দুই শিবিরে দুই স্পেনীয় কোচ এবার। মাঝে ৬ বছর কিন্তু
রেয়ালের হারের ব্যবধান একই, চার গোলের! কার্লো আনসেলোত্তির অভিশাপ?
দু’মরশুমে হোসে মোরিনিওর প্রভাব কাটিয়ে রেয়ালকে
ফুটবলের পথে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিলেন ইতালীয় আনসেলোত্তি। গত বছর বের্নাবেউতেই কোচ
লুইস এনরিকের অভিষেক হয়েছিল এল ক্লাসিকোয়, লুইস সুয়ারেজের তো বার্সেলোনা-অভিষেকই। দুমড়ে-মুচড়ে
দিয়েছিল রেয়াল, তীব্র গতির প্রতি আক্রমণে। জিতেছিল ৩-১, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর
পেনাল্টি এবং পেপে ও বেনজেমার গোলে। রেয়ালকে বড় সাধের ‘লা দেসিমা’ বা দশম
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেতাব এনে দেওয়ার পরও কর্তারা রাখেননি আনসেলোত্তিকে। ফল দেখুন।
নিজেদের মাঠে রেয়াল এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চার গোল খাচ্ছে শুধু নয়, সাত গোল খেলেও
বলার থাকত না কিছুই। আর এখন তো আবার জিনেদিন জিদান কোচ হলেন বলে!
কেন? রাফা বেনিতেজের দলে ফিরে এসেছে মোরিনিও-সিনড্রোমগুলো,
আবার! সের্খিও রামোস মারামারিতে মন দিয়েছেন, কার্ভাহাল তো চিরকাল এমনই করেন।
ম্যাচের শুরুতেই রামোসের জঘন্য ফাউল, রেফারি দেখেও্ দেখেন না বেশিরভাগ সময়। জানেনই
যে, রামোস এমন ফাউল আবারও করবেন, কার্ড দেখানোর সুযোগ এনে দেবেন যেচে, সেই ভেবেই
হয়ত। না হলে, সুয়ারজকে ওই ফাউলের জন্য কার্ড না-দেখানোর আর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া
সম্ভব নয়। রামোস তারপর ম্যাচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে যা যা সম্ভব করেছিলেন। বিপক্ষ
ফুটবলারের পায়ের ওপর পা দিয়ে দেওয়া, বক্সের মধ্যে সুয়ারেজকে পায়ে মেরে ফাউল
(রেফারি দেখেও দেখেননি, নিশ্চিত পেনাল্টি), পরে একবার হলুদ কার্ড দেখলেন বটে,
কিন্তু তার অনেক আগেই মাঠে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিলেন রামোস। জাভি এরনান্দেজ
টুইট করলেন ম্যাচ-শেষে, বক্তব্য, রেয়াল মাদ্রিদ হল ঠগীদের কারখানা! অধিনায়ক রামোসকে
দেখলেই বোঝা সম্ভব। এমনকি রোনালদোও কনুই চালালেন জেনেবুঝে, রেফারি কড়া হলে আলভেসকে
কনুই চালানোর জন্য লাল কার্ডও দেখাতেই পারতেন, আগে তাঁকে ফাউল করা হয়েছে এই সত্য
মেনে নিয়েই। ইসকোর লাল কার্ডে সমস্যা হয়নি, রোনালদোকে বের করে দিলে সমস্যা আরও বাড়ত
না কি রেয়ালের?
বার্সেলোনার জোড়া ফলার এই ম্যাচে তিন গোল! |
ট্যাকটিক্স-ট্যাকটিক্স করে চিৎকার করেন যাঁরা, আসলে
ট্যাকটিক্স হল রক্ষণে আরও জোর দেওয়া। যেমন মেরিনিও করেন, বেনিতেজও। দুজনের কখনই
বনে না, সেই কারণে। দেখতেই পারেন না একে অপরকে। বেনিতেজের একটা বলার মতো সাফল্য
আছে, ২০০৫ লিভারপুলের হয়ে সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। ০-৩ পিছিয়ে থেকে
দ্বিতীয়ার্ধে ৩-৩, পরে টাইব্রেকারে জয়। আনসেলোত্তি ছিলেন তখন মিলানে। ডিয়েটার
হামানকে নামিয়ে কাকার ছুটি করে দিয়েছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে, তাতেই জয়, লিখেছিলেন ব্রায়ান
গ্ল্যানভিল। হামান যদি এত বড়ই ফুটবলার হন যে কাকাকে ছুটি করে দিতে পারেন, তিনগোল
না-খাওয়া পর্যন্ত তাঁকে নামানো যায় না কেন, গ্ল্যানভিলকে এ-প্রশ্নটা করার সুযোগ
অবশ্য হয়নি! আর, ওই ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের শেষে কাকার ডিফেন্সচেরা থ্রু-টা
আন্দ্রে শেভচেঙ্কো যে ওভাবে মিস করবেন, সেটাও কি বেনিতেজ জেনেই নামিয়েছিলেন
হামানকে, জানা যায়নি।
তবু, জয় জয়ই। কিন্তু, তারপর বেনিতেজ লিভারপুলকে নিয়ে
বা অন্য আরও বহু দল নিয়েও কী করেছেন গত ধস বছরে, জানা যায়নি! অন্তত, রেয়াল
মাদ্রিদের কোচ হওয়ার মতো কিছু করেননি, গতবারের নাপোলির পারফরম্যান্সেই পরিষ্কার।
করিম বেনজেমা পুরোপুরি সুস্থ নন। ফরাসি সতীর্থের সঙ্গে অনুচিত কাজ করে পস্তেছেন।
কিন্তু, ক্লাসিকোয় খেলের মতো সুস্থ কি? ‘বিবিসি’ ধরে রাখতে আর চাপ বাড়াতে বেনিতেজ
নামিয়ে দিলেন, মাঠে রাখলেনও বেনজেমাকে। হামেস রদরিগেজ আর মার্সেলো, খানিকটা খেলার
চেষ্টা করছিলেন। দুটো শটও ছিল তিনকাঠিতে হামেসের যা দক্ষতার শীর্ষে থেকেই বাঁচাতে
হয় ব্রাভোকে। মার্সেলোও একবার আলভেজকে পেরিয়ে শেষে শটটা সাইড নেটে মারেন, গোলে
রাখতে পারলে হয়ত পরাস্ত করতেও পারতেন ব্রাভোকে। সেই দুজনকেই তুলে নিলেন। কী অসাধারণ
ফুটবল-মস্তিষ্ক!
লুইস এনরিকে কিন্তু লিওনেল মেসিকেও সুস্থ পেয়ে অযথা
তাড়াহুড়ো করেননি। মেসিকে ছাড়াই বার্সেলোনা যখন জিতে চলেছিল, নেইমার আর সুয়ারেজ
ম্যাচ বের করে আনছিলেন গত দু’মাসে, হঠাৎ করে সেই ছন্দ ভাঙতে চাননি। হ্যাঁ, মাঝমাঠে
ফিরিয়েছিলেন ইভান রাকিতিচকে। লুকা মোদরিচের ক্রোয়েশিয়া-সতীর্থর সঙ্গে মাঝমাঠ দখলের
লড়াইতে সমানে-সমানে লড়তে পারবেন বলে। দুই ক্রোয়েশীয় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছেন এল
ক্লাসিকোয়, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলের বিরাট বিজ্ঞাপন, অবশ্যই। মেসি কিন্তু মাঠে
এসেছিলেন তৃতীয় গোলের পর, রাকিতিচকে বিশ্রাম দিয়ে। অযথা হাঁকপাক না-করাটাও কোচেরই
কাজ!
মাঝমাঠ যতটা সংঘবদ্ধ থাকলে বার্সেলোনর কোনাকুনি
পাসগুলো আটকাতে পারে, রেয়ালের মাঝমাঠ তেমন ছিল না। সঙ্গে, সেন্ট্রাল ডিফেন্সে রামোসের
অদক্ষতা। ভারানে-কে আগে এই ম্যাচে যতটা ভাল দেখিয়েছে, ততটাই খারাপ শনি-রাতে, হয়ত
সঙ্গীর কারণেই। স্টপাররা খেলেন জুটিতে, ফুটবলের এই প্রাথমিক সত্য অনস্বীকার্য।
মাসচেরানোর দুর্ভাগ্যজনক বেরিয়ে যাওয়ার পরও বার্সেলোনাকে ভুগতে হয়নি পিকে-র সঙ্গে
পরিবর্ত মাথিউও জুটিতে যথেষ্ট ভাল খেললেন বলেই। আর হামেস-ক্রুস-মোদরিচের মাঝমাঠ রাকিতিচ-বুসকেতস-ইনিয়েস্তার
সঙগে লড়াইয়ের আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছিল যেন!
ম্যাচের সেরা হিসেবে নাম উঠছে দুজনের। আন্দ্রে
ইনিয়েস্তা ও ক্লদিও ব্রাভো। নেইমার-সুয়ারেজও খুব বেশি পিছিয়ে থাকবেন না। বের্নাবাউতে
প্রথমবার অধিনায়ক হিসেবে ইনিয়েস্তা অনবদ্য। এ-মরশুমের প্রথম গোল ও প্রথম অ্যাসিস্ট
এল তাঁর পা থেকে। নেইমারকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন দলের দ্বিতীয় গোলের সময়, তৃতীয় গোলের
সময় নেইমার অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পায়ের পেছনের টোকায় রেখে দিয়ে যান,
ইনিয়েস্তাকে শট করার জন্য। পরে নেইমার আবার মুনিরের জন্য যে-বলটা রেখেছিলেন, গোল
না-করাটা অপরাধ! পিকে এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে রীতিমতো বকলেন জুনিয়র মুনিরকে।
রেয়ালের মাঠে রেয়ালকে পাঁচগোল দেওয়ার সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া কে-ই বা করতে চায়!
প্রথম গোলের সময় ২৩ পাসের পর সের্খিও রোবের্তোর
অনবদ্য ডিফেন্সচেরা বাঁপায়ের থ্রু আর চতুর্থ গোলের সময় মেসির বল ধরে এগিয়ে যাওয়ার
পুরনো ছবির পাশাপাশিই রাখতে হবে ব্রাভোর অন্তত গোটা চারেক নিশ্চিত গোল-বাঁচানোও।
রেয়াল বেশ খারাপ খেললেও গোল লক্ষ্য করে শট নিয়েছিল বেশ কয়েকবার, অতর্কিতে। হামেসের
দুই, বেলের এক, বেনজেমার শট ও রোনালদোর প্লেসিং ও হেড - ব্রাভোকে তবু টলানো
যায়নি। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই
রেয়াল বেশ গতিতে শুরু করেছিল, বার্সেলোনাকে বল ধরতে না-দিয়েই। ওই সময় ২-০ এগিয়ে
ছিল বার্সেলোনা। ব্রাভো একটি গোলও খেলে আরও জাঁকিয়ে বসতে পারত রেয়াল। বলা যায় না,
হয়ত ফিরেও আসতে পারত ম্যাচে। চিলির অধিনায়ক তা হতে দেননি। ফলে, লা লিগায় ১২ রাউন্ড
শেষে রেয়ালের থেকে এখন ৬ পয়েন্টে এগিয়ে গেল বার্সেলোনা (৩০)। সার্বিক ফলের হিসেবেও
রেয়ালের আরও কাছে বার্সেলোনা, এখন ৯২-৯০।
আর, মেসিপ্রেমীদের জন্য সুখবর। তিন রাত পর, ইউরোপে,
রোমার বিরুদ্ধে আবার সেই বাঁ পায়ের জাদু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা, হয়ত শুরু থেকেই!