Friday, December 23, 2016

গোল্লাছুট ২৫


Wednesday, May 4, 2016

রিজোলির মতো দুঃখপ্রকাশ করবেন কি সাকিরও?




কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ইতালীয় রেফারি নিকোলা রিজোলি সম্প্রতি দুঃখপ্রকাশ করেছেন উয়েফার কাছে, বার্সেলোনার কাছেও। বার্সেলোনা-আতলেতিকো কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় পর্বের ৯৩ মিনিটে তিনি আতলেতিকোর গাবির বিরুদ্ধে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেননি বলে। ‘আসলে, গাবির পা ছিল বক্সের বাইরে। সেই জন্যই ভুলটা হয়ত, বলেছিলেন। ওই সময় পেনাল্টি পেলেই বার্সেলোনা গোল করত এবং খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়াত, এই নিশ্চয়তা কেউ কখনও দিতে পারেনি, পারবেও না। কিন্তু, ভুল ভুলই। এবং তাতে সুবিধে হয়েছিল আতলেতিকোর!

তুরস্কের রেফারি কুনেইত সাকিরও কি তেমন করবেন? প্রশ্ন উঠছে, কারণ, আতলেতিকো যে-গোলের কারণে ফাইনালে পৌঁছল, গ্রিজমানের সেই গুরুত্বপূর্ণ গোল এল যখন, গ্রিজমান অফসাইডে ছিলেন, তোরেসের পা থেকে পাস বেরনোর সময়! ইউরোপীয় ফুটবলের নকআউট ম্যাচে এমন সিদ্ধান্ত বারবারই তুল্যমূল্য ম্যাচের ফয়সালা করে দেয়। এবারও করল। এই সাকিরই ছিলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেই ম্যাচেও যখন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড দুর্দান্ত খেলছিল রেয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, একেবারেই বিনা কারণে নানিকে লাল কার্ড দেখিয়ে মোরিনিওর রেয়ালের হাতে ম্যাচটা থালায সাজিয়ে তুলে দিয়েছিলেন সাকির। এবার, আতলেতিকো ১-২ হারল বায়ার্নের কাছে। নিজেদের মাঠে জিতেছিল ১-০। ফলে, দুপর্ব মিলিয়ে ২-২। কিন্তু, গ্রিজমানের ওই ‘অ্যাওয়ে’ গোল বদলে দিল সমীকরণ। উয়েফার নিয়মে, দুপর্ব মিলিয়ে গোল সমান-সমান হলে ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচের এক গোলকে দু-গোল ধরা হবে। তাই, আতলেতিকো পৌঁছল ফাইনালে, বায়ার্নকে নিতে হল বিদায়। আর, অস্বস্তিকর হলেও সত্যি, পরপর দুটো নকআউট ম্যাচে, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, দুটো সিদ্ধান্তই গেল আতলেতিকোর পক্ষে!

পেপ গারদিওলাকে আবার তাড়া করল ন্যু কাম্পের ভূত! ২০১২ সালে পরিস্থিতি ছিল এমনই। চেলসির কাছে প্রথম পর্বে ০-১ পিছিয়ে নিজেদের মাঠে খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। প্রথমার্ধেই দু-গোলে এগিয়ে যায়। তারপর, প্রতি আক্রমণে রামিরেজের ‘অ্যাওয়ে’ গোল, চেলসিকে যা এনে দিয়েছিল জিয়নকাঠি। অন্তত আরও একটি গোলের সন্ধানে মরিয়া বার্সেলোনা দ্বিতীয়ার্ধে দুরন্ত। পেনাল্টি পায়। কিন্তু, লিওনেল মেসি সেই পেনাল্টি মেরেছিলেন বারে! এবারও বায়ার্ন পেনাল্টি পেয়েছিল। বায়ার্নে সাধারণত পেনাল্টি মারেন টমাস মুলার। তিনিই এগোলেন, ২-০ করার লক্ষ্যে। কিন্তু, মুলারও সহজ শট নিলেন, চাপের মুখে। জান ওবলাক, আতলেতিকোর গোলরক্ষক, বাঁচালেন সহজেই। বায়ার্ন পিছিয়ে পড়ল ওই মুহূর্ত থেকেই। এখানেই মিল শেষ নয়। ২০১২য় শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ২-২ করেছিলেন তোরেস। সেই তোরেসই এবারও সুযোগ পেয়েছিলেন ২-২ করার যখন বায়ার্নের বিরুদ্ধে ভুল পেনাল্টি দেওয়া হয়েছিল। জাভি মার্তিনেজ ফাউল করেছিলেন বক্সের বাইরে, তোরেস লাফিয়ে এসে লুটিয়ে পড়েছিলেন বক্সের ভেতরে। কিন্তু ৮৫ মিনিটের সেই পেনাল্টি নুয়াররের দিকেই মেরে জয় সুনিশ্চিত করার সুযোগ নষ্ট করেন তোরেসও।

৯০ মিনিট জুড়ে তিন গোল, দুটি পেনাল্টি, দুটিই নষ্ট, রেফারির কিছু ভুল সিদ্ধান্ত – ইউরোপের সেরা প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে সব নাটকই ছিল। এক দল খেলা গড়তে চেষ্টা করল, অন্যদল চাইল ভাঙতে। ম্যাচের চাপ এতটাই যে, দুই কোচই গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়লেন। প্রথমার্ধে তো একবার রিবেরি এসে সিমিওনে-কে ধরে ফেললেন, আটকাতে! আর সিমিওনে শেষে নিজের দলের সহকারী ম্যানেজারের হাতে চড়ই মেরে ফেললেন, অত্যন্ত দৃষ্টিকটু যা। তবে, নিজের দলের সহকারী ম্যানেজারের গায়ে হাত দিলে শাস্তি কী হবে নিয়ে উয়েফার নিয়ম পরিষ্কার নয়। তাই, সিমিওনের শাস্তি হবে কিনা, উয়েফা জানাবে। হলে, ফাইনালে মাঠে থাকতে পারবেন না, আতলেতিকোর কাছে যা অভিশাপ হতে পারে।

গারদিওলার বায়ার্ন তিন বছরে তিনবারই বিদায় নিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে, স্পেনের তিনটি দলের কাছে হেরে – যথাক্রমে রেয়াল, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো। বায়ার্নকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হল না। ‘চেষ্টা করেছিলাম সর্বস্ব দিয়েই। ফুটবলাররাও দুর্দান্ত খেলেছে। কিন্তু, পারেনি শেষ পর্যন্ত। হতাশ, তবে ওদের পারফরম্যান্সে গর্বিতও। আতলেতিকোকে অভিনন্দন।’ আর সিমিওনে খুশি, এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা তিন দলের দুটিকে পরপর দুটি নকআউট ম্যাচে হারিয়ে। ‘পরপর দুটো নকআউট ম্যাচে বার্সেলোনা ও বায়ার্নের বিরুদ্ধে জয়, ভাবতেই যেন কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তবে, এটা আমাদের ফুটবলারদের দায়বদ্ধতার জয়। মাঠে নিজেদের সবটুকু দিয়েছে। দলটা ক্রমশ এক হয়ে উঠেছে, ওদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।’



তিন বছরে দুবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ২৮ মে ফাইনালের আগে আপাতত এই মধুর সময়টা উপভোগ করতে চান সিমিওনে!

Tuesday, April 26, 2016

রেয়াল মাদ্রিদ অনেক এগিয়ে, নিঃসন্দেহে



কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ম্যাঞ্চেস্টার শহরের যে-দিকটা ‘লাল’, মেতে রয়েছে এফএ কাপ ফাইনাল নিয়ে। আর, শহরের যে দিকে ‘নীল’ রঙের প্রাধান্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাকাতে চাইছে ইউরোপ মহাদেশের বৃহত্তর ছবিটার দিকে!

কিছু দিন আগেও ছবিটা ঠিক উল্টো ছিল ম্যাঞ্চেস্টারের দুই ক্লাবে। সময় বদলেছে, পাল্টেছে দুই দল, পরিবর্তন এসেছে দুই ক্লাবের সাফল্যের লেখচিত্রে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ছাড়পত্র জোগাড় করতেই হিমশিম। শহর-শত্রু ম্যাঞ্চেস্টার সিটি দৌড়চ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে!

সেই স্বপ্ন আর সান সিরোয় ফাইনালের মাঝে আপাতত এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অন্যতম ফেভারিট ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর রেয়াল মাদ্রিদ। নিজে যখন ‘লাল’ দলে ছিলেন, রোনালদো বহুবার এসেছেন খেলতে, ‘নীল’ দিকে। অধিকাংশ সময়ই জিততেন। শুধু, ভুলে যাওয়ার মতো দুটি ঘটনা ছিল তাঁর, নীল-দিকে এসে। ২০০৪ আর ২০০৮, দু-বার দেখেছিলেন লাল কার্ড। কিন্তু পর্তুগিজ তারকা এখন আরও পরিণত। জানেন, বছর শেষে ফিফার বালন দি’ওর মঞ্চে উঠতে শুধু নয়, হাতে ট্রফি তুলতে গেলে, লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে আগামী তিন ম্যাচে (দুটি সেমিফাইনাল ও ফাইনাল) জয়ের দিকেই!

সিটির স্বপ্ন-দেখানো তারকার অতীত-ইতিহাস অবশ্য বেশ খারাপ। সের্খিও আগেরো আগে ছিলেন আতলেতিকো মাদ্রিদে। যতবার খেলেছিলেন রেয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে, একবারও জেতেননি! তিন বছর আগে যখন একই গ্রুপে ছিল রেয়াল আর ম্যান সিটি, ঘরের মাঠে ১-১ রেখেছিল রোবের্তো মানচিনির সিটি। কিন্তু, বের্নাবেউ-তে গিয়ে হারতে হয়েছিল ১-৪। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলের আশা, এবারও তেমনই হবে। হয়ত, এতিহাদে এসেও গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় তুলে নিয়েই ফিরবেন জিনেদিন জিদান। বেলজিয়ামের কেভিন দে ব্রুইন-কে নিয়ে যদিও সামান্য চিন্তা থাকবেই। তরুণ প্রতিভা যতবার খেলেছেন সিটির হয়ে, নিরাশ করেননি।


ঘরের মাঠে সিটির সম্ভাব্য হারের পেছনে কারণ হিসাবে উঠে আসছে দুর্বল রক্ষণ। কোম্পানির চোট, মাঝমাঠে ইয়াইয়া তোরেও নেই। বিবিসি বা বেনজেমা-বেল-ক্রিস্তিয়ানোর ঝড় সামলাতে কি ওতামেন্দি-মঙ্গলার ডিপ ডিফেন্স তৈরি? প্রিমিয়ার লিগের দলের আক্রমণ আর রেয়াল মাদ্রিদের আক্রমণে তফাৎ প্রচুর। দক্ষিণ আমেরিকার দুই দলের এমন কিছু ফুটবলার মানু্য়েল পেয়েগ্রিনির দলে, বড় আসরে যাঁরা কিছুই জেতেননি। শুনতে খারাপ হলেও তা সত্যি, আগেরো-ওতামেন্দির আর্জেন্তিনা বা ফের্নান্দো-ফের্নান্দিনিওর ব্রাজিলের ক্ষেত্রে। ফুটবলারদের ‘জাত’ নিয়ে বিচারে বসলে রেয়াল মাদ্রিদ অনেকটাই এগিয়ে, নিঃসন্দেহে।

তবুও, ফুটবল মানে খাতা-কলমের বিচার নয়। সেই দিন, নির্ধারিত ৯০ মিনিট, কারা কেমন ছন্দে, ঠিক করে দেয় ফল। পেয়েগ্রেনির যেমন মনে হচ্ছে, রোনালদোকে আটকানো সম্ভব। তিনি তখন রেয়ালে, রোনালদোকে আনা হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড থেকে। ‘একা রোনালদোকে নিয়ে ভাবলে তো আর চলবে না। বাকিদেরও দেখতে হবে। আমাদের সুবিধে, দলটা ছন্দে আছে। প্রিমিয়ার লিগে শেষ পাঁচ ম্যাচে চারটি জিতেছি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজি-র মতো দলকে হারিয়ে উঠে এসেছি সেমিফাইনালে। বড় দল মানে ঘরোয়া লিগের পাশাপাশি ইউরোপের নকআউটেও শেষ দিক পর্যন্ত টিকে থাকা। সিটি প্রথম খেলবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে। জিততে পারলে তো নতুন ইতিহাস!’

সবচেয়ে বেশি ২৭ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে-ওঠা রেয়াল মাদ্রিদও তো নতুন ছন্দে, কোচের আসনে জিদানকে পেয়ে! শেষ দশটা ম্যাচে হার বলতে একমাত্র উলফসবুর্গের কাছে, অ্যাওয়ে ম্যাচে। সেই ০-২ ব্যবধানও নিজেদের মাঠে রোনালদোর হ্যাটট্রিকে পেরিয়ে প্রথম চারে। হ্যাঁ, শেষ ছ’বছর ধরেই রোনালদোরা সেমিফাইনালে এলেও জিতেছিলেন একবার, তথ্য হিসাবে যা খুব স্বস্তি দিচ্ছে না হয়ত। জিদান অবশ্য খুশি অন্য কারণে। ‘কঠিন ম্যাচ হবে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল মানেই কঠিন। শুধু ভাল লাগছে ভাবতে যে, দ্বিতীয় পর্ব আমরা খেলব নিজেদের মাঠে। তাই ইতিবাচক থাকতে বলেছি সবাইকে। সহজ ম্যাচ? উলফসবুর্গ ম্যাচের আগেও একই কথা বলা হয়েছিল, ফলটা আশা করি মনে আছে সবার!’ ঠিক, কিন্তু, ১৮০ মিনিট মিলিয়ে রেয়াল বিদায় নিচ্ছে, এই ছবিটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না!



১০ ম্যাচে ১৬ গোল, আর একটা করলে ইউরোপে এক মরশুমে নিজের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ। আজ এতিহাদে পারলে আরও একটু এগিয়েই যেতে চাইবেন রোনালদো!

Friday, April 22, 2016

গারদিওলা-এনরিকে-সিমিওনে-জিদানদের ভিড়ে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক মোরিনিও-বেনিতেজ





ভাল ফুটবলার হলে ভাল কোচ হওয়া যায় না? ইংরেজি মিডিয়াশ্রিত এই ভাবনায় সওয়ার হবেন না প্লিজ, লিখলেন

কাশীনাথ ভট্টাচার্য


জিনেদিন জিদানের রেয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখের কোচ পেপ গারদিওলা, আতলেতিকো মাদ্রিদের দিয়েগো সিমিওনে, ম্যাঞ্চেস্টার সিটির দায়িত্বে মানুয়েল পেয়েগ্রিনি। যথাক্রমে ফ্রান্স, স্পেন, আর্জেন্তিনা ও চিলির চার ফুটবলার, যাঁদের মধ্যে পেয়েগ্রিনি ছাড়া প্রত্যেকেই জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন! এই চার দলই আছে এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেতাবি দৌড়ে।

ফুটবলে প্রচলিত কথা, ফুটবলার হিসাবে যত বড়ই হোন না কেন, কোচ হিসাবে তত বড় হওয়া নাকি সম্ভব নয়!

আমাদের ভারতে এর ব্যতিক্রম দেখিয়েছেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে পিকে ব্যানার্জি। পরে তাঁর দুই ছাত্র সুভাষ ভৌমিক এবং সুব্রত ভট্টাচার্য। আন্তর্জাতিক আসরে তো ছড়াছড়ি। মারিও জাগাও (Zagallo) ছিলেন। ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ফুটবলার হিসাবে। ১৯৭০ সালে কোচ হয়ে। পরে আবার ১৯৯৪ সালেও ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলে ছিলেন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসাবে। ফুটবলার হিসাবে দুবার বিশ্বকাপ জয়ের পর কোচ এবং টিডি হিসাবে আরও দুবার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব আর কারও নেই! ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারও ফুটবলার হিসাবে ১৯৭৪ সালে বিশ্বজয়ের পর ম্যানেজার হিসাবে বিশ্বজয় করেছিলেন ১৯৯০ সালে। যাঁরা ফুটবলার হিসাবে তত বড় নন, বিশ্বকাপে খেলারই সুযোগ পাবেন না, নিশ্চিত। তাই তাঁদের পক্ষে এমন রেকর্ড নিয়ে ভাবাই অর্থহীন!
মারিও জাগাও


গোড়ায় গলদ এমন ভাবনার যা বলে, ভাল ছাত্র হলে ভাল শিক্ষক হওয়া যায় না! প্রধানত ইংরেজ মিডিয়ার সৌজন্যে এমন এক ভাবনা প্রচলিত, মধ্যচিত্ততাকে মহান হিসাবে তুলে ধরতে চাওয়ার কারণে। প্রতিভাবানরা পরিশ্রমবিমুখ, এমন প্রচার তাঁরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। পেশাগত দিক দিয়ে কোচিং পরিশ্রমসাপেক্ষ বলা হয়। যেন ফুটবল খেলাটা পরিশ্রমসাপেক্ষে নয়! তাদের এই ভাবনার সমর্থনে কিছু উদাহরণও পাওয়া গিয়েছে। পেলে সেভাবে কখনও আসেননি প্রশিক্ষণে। যেমন আমাদের ভারতে আসেননি চুনী গোস্বামীও। কিংবা, কোচ হিসাবে কাজ করতে এসে যারপরনাই ব্যর্থ দিয়েগো মারাদোনা। কিন্তু, তার মানে কি এই যে, সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবলাররা কোচিংয়ে এলেই ব্যর্থ হবেন? জোহান ক্রুয়েফের চেয়ে বড় কোচ আর কে, যিনি ফুটবলার হিসাবে কোচ রাইনাস মিশেলের হাতে পড়ে ফুটবলকে বদলে দিয়েছিলেন, আবার কোচ হিসাবে নিজে এতজন ফুটবলারকে প্রভাবিত করেছেন যে, পাল্টে গিয়েছে আধুনিক ফুটবলের সংজ্ঞাই? ফুটবল ইতিহাসে তিনি তো অনন্য, একা!

আর এই ভাবনাকে গতি দিয়েছিল সাম্প্রতিক অতীতে দুই ব্যর্থ ফুটবলারের কোচ হিসাবে ইংরেজ ফুটবলে আশাতীত সাফল্য। ২০০৪-০৫ মরসুমে দুজনেই এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। হোসে মোরিনিওকে এনেছিল চেলসি, রাফায়েল বেনিতেজকে লিভারপুল। ২০০৩-০৪, এফসি পোর্তো জিতেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, মোরিনিওর প্রশিক্ষণে। আবার বেনিতেজের লিভারপুল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে ২০০৪-০৫। পরপর দু-বছর এই দুই মধ্যচিত্ত কোচের জয় যেন জোয়ার এনে দিয়েছিল মধ্যবিত্ত ভাবনায়। ইংরেজি মিডিয়াজুড়ে প্রশস্তি। মোরিনিও চেলসিতে এসে সেরা দল তৈরি করেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আনতে পারলেন না, বেনিতেজ যেমন আনতে পারেননি ইপিএল খেতাবও। কিন্তু তাঁদের প্রশিক্ষণ-ভাবনা, যা প্রধানত রক্ষণ নিয়ে আরও, আরও এবং আরও বেশি ভাবতে বাধ্য করায়, উঠে এসেছিল সাফল্যের প্রধান কারণ হিসাবে। আর রক্ষণাত্মক ভাবনার সুবিধা, দলে মোটামুটি মানের ফুটবলারের আধিক্য হলে ভাল হয়। সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করার ঝামেলা অনেক। তাঁরা উৎকর্ষ খুঁজবেন, মধ্যচিত্ততা খুঁজবে সাফল্য। মোরিনিও পেলেন ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে, বেনিতেজের হাতে স্টিভেন জেরার্ড। দুজনেই আদ্যন্ত কোচ-নির্ভর ফুটবলার’, মানে কোচ যা বলবেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ পারফরমার। ইংরেজ সংবাদমাধ্যম উদ্বাহু, স্বাভাবিক! তাঁদের দেখাদেখি ভারতের ইংরেজি-শিক্ষিতরাও। প্রচলিত শুধু নয়, জনপ্রিয় হয়ে উঠল ‘আক্রমণ ম্যাচ জেতায়, রক্ষণ জেতায় ট্রফি।’ গত একযুগ ধরে বার্সেলোনা তা হলে গোটা ২০ ট্রফি জিতল কি পিকে-আলভেস-মাসচেরানোর জন্য - মেনে নিতে হবে?

যা হওয়ার ছিল, হলও। এই সুসংগঠিত প্রচারের ঝড় আস্তে আস্তে গতি হারাতে শুরু করল। মোরিনিওর মালিক ইউরোপে সাফল্য না পেয়ে আর এত পয়সা খরচ করেও নিজের দলকে বার্সেলোনার মতো খেলতে দেখতে না-পেয়ে তাড়ালেন তাঁকে। বেনিতেজ আবারও উঠেছিলেন ইউরোপের ফাইনালে, কিন্তু এসি মিলান তাঁকে দ্বিতীয়বার ভুল করে সুযোগ দেয়নি মহৎহয়ে ওঠার, যে-সুযোগটা বার্সেলোনা দিয়েছিল মোরিনিওকে। তাতে অবশ্য সুবিধাই হল। রেয়াল মাদ্রিদ ডেকে নিল জামাই আদরে মোরিনিওকে। তারপর  প্রকাশ্যে এল তাঁর তারকা সামলানোর ব্যর্থতা এবং দুর্দান্ত দল হাতে পেয়েও আক্রমণাত্মক হতে না-চাওয়ার চূড়ান্ত মধ্যবিত্ত ভাবনা। রেয়ালও রাখল না দায়িত্বে। বেনিতেজকে এনেও একই ভাবে সরিয়ে দেওয়া হল, প্রত্যাশিত মানের ফুটবল না-পেয়ে। স্পেন সাফল্যখোঁজে যেমন, একই সঙ্গে খোঁজে মান। কুৎসিত ফুটবল খেলে সাফল্য আনার যে-রাস্তায় হাঁটতেন মোরিনিও-বেনিতেজ, রেয়াল মাদ্রিদ তাঁদের দুজনকেই বাতিল করে বুঝিয়ে দিয়েছে, ভাল ফুটবল খেলে সাফল্য আনার রাস্তাতেই দলকে রেখে দিতে চায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

মোরিনিওর খুব আশা ছিল, অ্যালেক্স ফার্গুসন চলে যাওয়ার পর তাঁকে জামাই আদরে ডেকে নেবে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু ফার্গুসন তাঁকে মনোনীত করে যাননি। বাধ্য হয়ে চেলসিতে আবার। আরও একটা প্রিমিযার লিগ এলেও খেলার ধরনে কোনও পরিবর্তন আসেনিযেমন আসেনি তারকাদের ঠিকঠাক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতায়। আবার বিদায়। তারপর থেকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতে কখনও দ্বিধা করেননি যেমন, ইংরেজ মিডিয়াও রোজই লিখে গিয়েছে এবং যাচ্ছে যে, এই মোরিনিও ইউনাইটেডে এলেন বলে। এই লেখার দিন পর্যন্ত যদিও তেমন কোনও নিশ্চয়তার কথা সরকারিভাবে শোনা যায়নি। বেনিতেজকেও রেয়াল ছুড়ে ফেলার পর আসতে হয়েছে সেই অগতির গতি ইংল্যান্ডেই, নিউক্যাসল ইউনাইটেডে, যারা এখন অবনমন বাঁচাতে লড়ছে।

মোরিনিও-বেনিতেজদের বাজারদর যখন ক্রমশ নেমেছে, উঠে এসেছেন একঝাঁক সর্বোচ্চ মানের ফুটবলার, কোচের আসনে, তাঁদের আক্রমণাত্মক দর্শন নিয়ে। এখানেও পথপ্রদর্শক ছিল বার্সেলোনাই। ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ফুটবলার হিসাবে সর্বোচ্চ স্তরের। তাঁর হাত ধরেই বার্সেলোনার উত্থান শুরু হয়েছিল। তারপর, এক মরসুমে যখন ব্যর্থ, মোরিনিও তখনও চেষ্টা করেছিলেন বার্সেলোনার ম্যানেজারি পাওয়ার। একেবারে এখনকার ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতোই। বার্সেলোনা-কর্তৃপক্ষ মানেনি। নিজেদের দর্শনধরে রাখতে বার্সেলোনা বিদল থেকে তুলে এনেছিল গারদিওলাকে। চার বছরে ১৪ ট্রফি দিয়ে গারদিওলা বিদায় নিয়েছিলেন যখন, বার্সেলোনাকে অন্য গ্রহের দল আখ্যা দিয়ে দিয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। লিওনেল মেসি উঠে এসেছিলেন এই গ্রহের সন্দেহাতীত সেরা ফুটবলার হয়ে। এক বছর বিশ্রাম নিয়ে বায়ার্ন মিউনিখে যান গারদিওলা। এবার তাঁর তৃতীয় বছর, জার্মান লিগ তৃতীয় বার জিততে চলেছে বায়ার্ন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে উঠেছে। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে সাত মরসুম থেকে সাতবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে তুলেছেন গারদিওলা, অভূতপূর্ব সাফল্য বললেও কম! উঠেছেন জার্মান কাপের ফাইনালেও। ত্রিমুকুটের সন্ধানে ঠিক রাস্তায় এবং ঠিক হাতেই আছে বায়ার্ন।

যদিও এই মরসুমের শেষেই বায়ার্ন ছাড়বেন গারদিওলা। যিনি আসবেন, প্রাক্তন ফুটবলার এবং তিন-তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন কোচ হিসাবে কার্লো আনসেলোত্তি। এসি মিলানের একটি রেকর্ড এখনও অটুট। শেষ ক্লাব হিসাবে তারা পরপর দুবার ইউরোপ-সেরা হয়েছিল ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে। সেই মিলানে গুলিত-বাস্তেন-রাইকার্ড ডাচ ত্রয়ীর সঙ্গে ইতালীয় সতীর্থ বারেসি-মালদিনিদের পাশেই খেলতেন আনসেলোত্তি। ফুটবলার হিসাবে তাঁর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। রেয়ালকে দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেতাব এনে দেওয়ার পরও লা লিগা জেতাতে না-পারায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বড় ভুল নিঃসন্দেহে। এক মরসুম বিশ্রাম নিয়ে তিনি ফিরবেন বায়ার্নে, জার্মান চ্যাম্পিয়নরা নিশ্চিন্ত!
জিদান, আনসেলোত্তি


ফ্রান্সে ভাল কাজ করছেন প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লরাঁ ব্লাঁ। ১৯৯৮ বিশ্বজয়ী ফ্রান্স দলের সদস্য, ক্রুয়েফের স্বপ্নের বার্সেলোনারও। প্যারিস সাঁ জাঁ-র দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৩ সালে। পরপর চারবার ফরাসি লিগ জিতেছে দল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে হারলেন আবার, সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজ প্রচারমাধ্যম মোরিনিওর নাম তুলে আনল বাজারে! কিন্তু, ব্লাঁ-কে সরানোর কোনও ভাবনা নেই আপাতত, বলেছে পিএসজি। আক্রমণাত্মক ফুটবলের আদর্শে অনুপ্রাণিত। দলে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলারদের প্রাধান্য, খেলাতেও রক্ষণকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। থাকলে দাভিদ লুইজকে দলে রাখতেন না, নিশ্চিত!

লুইস এনরিকে তো বার্সেলোনায় এসে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যেন! মেসির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার আরও দুই দেশের দুই ফলা, ব্রাজিলের নেইমার ও উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজকে। বার্সেলোনা হয়ে উঠেছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। টানা ৩৯ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড করে হারে শেষে জিদানের রেয়ালের কাছে। ত্রিমুকুটের স্বপ্ন চুরমার হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে সিমিওনের আতলেতিকোর কাছে হেরে। লা লিগাতেও টানা তিনটি ম্যাচ হারার পর গেল-গেল রব উঠেছিল। তবু, দেপোর্তিভোকে আট গোল দিয়ে এখনও শীর্ষে, যদিও পয়েন্টের বিচারে আতলেতিকোর সঙ্গে সমান ও রেয়াল থেকে মাত্রই এক পয়েন্টে এগিয়ে। বার্সেলোনায় আসার পর ১১৭ ম্যাচে ৯১ জয়, মাত্র ১৩ হার এনরিকের এমন রেকর্ড গারদিওলার প্রথম দুবছরের চেয়েও ভাল। হ্যাঁ, এনরিকেও খেলেছিলেন বার্সেলোনায়, গারদিওলা-ব্লাঁ-ফিগোর সঙ্গে। সেই দলেই ছিলেন হুলেন লোপেতেগি, এখন যিনি এফসি পোর্তোর কোচ এবং বেশ ভাল কাজই করছেন।
দিয়েগো সিমিওনে


একেবারে হালে রেয়ালের দায়িত্ব নিয়েছেন জিনেদিন জিদানও। ফুটবলার হিসাবে ঠিক কোন স্তরের ছিলেন জিদান, আলাদা করে আলোচনা অর্থহীন! এবং বেনিতেজকে সরিয়ে তাঁকে আনার পেছনে রেয়াল কর্তৃপক্ষের ভাবনাও অনেকটা গারদিওলাকে আনার সময় বার্সেলোনার ভাবনার মতোই। এমন একজন যিনি ক্লাবটাকে চেনেন, জানেন খুব ভাল করে, খেলাতে চান সেই আক্রমণাত্মক ফুটবলের সহজাত ছন্দ ধরে রেখে। তা ছাড়া, আনসেলোত্তির সঙ্গে সহকারী হিসাবে কাজ করে হাত পাকিয়েছিলেন জিদান। এই মুহূর্তে দুটি ট্রফির দৌড়ে আছে রেয়াল – লা লিগা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ইউরোপে জিততে পারলে নিশ্চিতভাবেই অন্য উচ্চতায় পৌঁছবেন জিদান এবং সে-সম্ভাবনা উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। অন্তত ফাইনালে না-উঠলে তো অঘটনই! রোনালদোরা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে হারাতে পারবেন না, ভাবা কঠিন।

জিদানের আর এক সতীর্থ ক্লদ ম্যাকেলেলেও এসেছেন ক্লাব কোচিংয়ে। যেমন, জিদানদের অধিনায়ক দিদিয়ের দেশঁ ২০১২ থেকে আছেন ফ্রান্সের দায়িত্বে। ১৯৯৮-এ ফুটবলার হিসাবে নিজের দেশে বিশ্বকাপ জেতানোর পর এবার নিজের দেশে ইউরো জেতানোর লক্ষ্য দেশঁর, কোচ হিসাবে! এসি মিলানের দুই প্রাক্তন ক্লারেন্স সিডর্ফ ও ফিলিপো ইনজাঘিও বসছেন বেঞ্চে, বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে। রায়ান গিগসকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বেঞ্চে লুই ফন হালের পাশেও দেখা যাচ্ছে নিয়মিত।


গারদিওলা-এনরিকে-সিমিওনে-জিদানদের ভিড়ে তাই ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক মোরিনিও-বেনিতেজ। আর, সেরা ফুটবলারদের এভাবে কোচিংয়ে নিয়মিত হয়ে ওঠাটাই হয়ত এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক!

Friday, April 15, 2016

‘মেসিলোনা’-র ত্রিমুকুটের স্বপ্ন চুরমার !


কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ফিফা-ভাইরাস, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অভিশাপ, ক্লান্তি। কারণ তবুও এর কোনওটাই নয়! বার্সেলোনার ত্রিমুকুট জেতার স্বপ্ন চুরমার হল ভিসেন্তে কালদেরনে, নিজেদের জন্যই। এত খারাপ খেললে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার অধিকার থাকে না, সহজ সত্য!

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে বাকি দুই দল হিসাবে গেল আতলেতিকো মাদ্রিদ ও বায়ার্ন মিউনিখ। ২-০ জিতল আতলেতিকো, গ্রিজমানের জোড়া গোলে। বায়ার্নকে (২-২) টেনে নিয়ে গেল ভিদাল ও মুলারের গোল। ঘরের মাঠে ১-০ জয়ই ব্যবধান হয়ে থাকল। পেপ গারদিওলার কোচ হিসাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সপ্তম মরসুম। সাতবারই তাঁর দল সেমিফাইনালে খেলেছে। অনন্য রেকর্ড বললেও কম!


য্খন রেয়াল মাদ্রিদের দরকার ছিল, হ্যাটট্রিক করেছিলেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। যখন বার্সেলোনা তাকিয়েছিল লিওনেল মেসির দিকে, গোলে একটা শটও রাখতে পারলেন না বিশ্বের সেরা ফুটবলার! এমনকি, শেষ মিনিটে যখন রেফারি নিকোলা রিজোলির ভুল সিদ্ধান্তে পেনাল্টি না-পেয়ে ফ্রি কিক পেয়েছিল বার্সেলোনা, মেসি সেই শটটাও মারলেই বাইরে। চাপের সময় ওখান থেকে গোল করতে পারলেও অতিরিক্ত সময়ে গড়াত খেলা। পারেননি। ঠিক যেমন পারেননি অনুরূপ পরিস্থিতিতে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালেও ফ্রি কিক থেকে গোলে রাখতে। ৪৫২ মিনিট তিনি গোলহীন, ‘মেসিলোনাও ছন্দহীন!

মেসির নায়ক হওয়ার মঞ্চে নায়ক হয়ে গেলেন আর এক আর্জেন্তিনীয় দিয়েগো সিমিওনে। বার্সেলোনাকে দুবার হারালেন তিনি ১৭-ম্যাচে। দুবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউটে। বার্সেলোনা গত আট বছরে এই দুবারই সেমিফাইনালের আগে থামল। আতলেতিকো মাদ্রিদের রক্ষণাত্মক রেকর্ড ঈর্ষণীয়। মরসুমে ৪৫ ম্যাচের মধ্যে ২৮ ম্যাচে কোনও গোল খায়নি! লুইস এনরিকে আগে সাতবারই হারিয়েছিলেন। একবার জিতলেন সিমিওনে। মোক্ষম সময়ে!

গ্রিজমানের দুটো গোল, দুই অর্ধে। প্রথমবার সাউলের সেন্টারে মাথা ছুঁইয়ে, দ্বিতীয়টা পেনাল্টি থেকে। সেই পেনাল্টি যা আতলেতিকো পেয়েছিল বক্সের মধ্যে বার্সেলোনা-অধিনায়ক ইনিয়েস্তা বাঁহাত দিয়ে বল আটকানোয়। নিশ্চিত লাল কার্ড। রেফারি রিজোলি কেন হলুদ দেখিয়েছিলেন, বলা কঠিন। তাঁর রেফারিং নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন এমনিতেও, সব সময়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে তিনিই ম্যানুয়েল নয়ারকে লাল কার্ড দেখাননি, গোনজালো ইগাইনের ঘাড়ে চেপে গালে ঘুষি মারার পরও! এখানে ইনিয়েস্তাকে তখন লাল কার্ড দেখালে খেলার শেষ মিনিটে যে-পেনাল্টি না-পাওয়ার জন্য বার্সেলোনা আপসোস করছে, প্রশ্নটাই উঠত না! ইনিয়েস্তার শটই তো বক্সের মধ্যে হাতে লাগিয়েছিলেন তখন আতলেতি-অধিনায়ক গাবি!

সিমিওনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন ফুটবলারদের। এই দলটা অন্যরকম। সবাই বিশ্বাস করে, পারবে। পেরেই দেখাল। লড়াই ওদের রক্তে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে গেল। হারজিত থাকে, থাকবেও। কিন্তু, সমাজ যখন আদর্শহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশ, আমাদের দল দেখিয়ে যাচ্ছে, আদর্শের জন্য সব কিছু করা সম্ভব। কখনও বিশ্বাস হারায়নি।এনরিকে-র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পেনাল্টির সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক দিলেই কি বার্সেলোনা এগিয়ে যেতে পারত? গত মরসুমে পাঁচ-ট্রফি পাওয়া কোচ পরিষ্কার বলেছেন, ‘দেখতে পাইনি ঠিক করে। পেনাল্টি ছিল? হতে পারে! কিন্তু, আতলেতিকো যোগ্য দল হিসাবে জিতেছে, ওদের অভিনন্দন জানানোই কর্তব্য, সেটাই করছি। ভাল খেলতে পারিনি, পারছি না কয়েকটা ম্যাচে। ৯৯ দশমিক নয় নয় শতাংশও নয়, একশো শতাংশ দোষই আমার। হাতে এখনও দুটো ট্রফির জন্য লড়াই রয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।

সেমিফাইনালের চার দলকে বিশ্লেষণ করেছেন গারদিওলা। ম্যাঞ্চেস্টার নতুন ইতিহাস লিখতে চাইছে, রেয়াল মাদ্রিদ বরাবরের মতোই তৈরি, আর আতলেতিকোর মানসিকতার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তাই, কাদের বিরুদ্ধে খেলতে হবে নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। লটারিতে যাদের বিরুদ্ধে নাম উঠবে, প্রস্তুতি নিতে হবে সেই দিকে তাকিয়েই।প্রসঙ্গত, সেমিফাইনালের লটারি আজ শুক্রবার, ভারতীয় সময় বিকেল তিনটেয়, সুইৎজারল্যান্ডের নিয়ঁ-তে। আর হ্যাঁ, ম্যাঞ্চেস্টার সিটির নাম যদি ওঠে বায়ার্নের বিরুদ্ধে, ‘গারদিওলা-বর্তমানদলের বিরুদ্ধে খেলা পড়বে গারদিওলা-ভবিষ্যৎদলের!

ফুটবল নিষ্ঠুর খেলা, গারদিওলা বারবার বলেন। বার্সেলোনা তার চরম নিদর্শন। ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে যাওয়ার আগে লিগে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে, কোপা দেল রে ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছে, যে কোনও দলকে স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছে এম-এস-এন ত্রয়ী। বাছাইপর্ব থেকে ফেরার পরের চার ম্যাচে জয় মাত্র একটি, বিদায় নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে, লা লিগায় ব্যবধান কমে এসেছে তিনে। এখন তো প্রশ্ন, লা লিগাতেও কি খেতাব ধরে রাখতে পারবে এই ছন্নছাড়া মেসিলোনা’?


রোনালদোর দুরন্ত হ্যাটট্রিক...


কাশীনাথ ভট্টাচার্য

রেমোন্তাদা, রোনালদো - বের্নাবেউ নাচল-গাইল এই দুই শব্দে! জব্দ করল উল্ফসবুর্গকে, পৌঁছল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে টানা ছ'বার, রোনালদোর হ্যাটট্রিকে। মঙ্গল-রাতে অন্য ম্যাচে এতিহাদে ইতিহাস লিখল ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, প্রথমবার ইউরোপে সেমিফাইনালে উঠে, কেভিন ডে ব্রুইনের গোলে জিতে।

রেমোন্তাদা স্পেনীয় শব্দ। অর্থ, ফিরে আসা। এমন পরিস্থিতি থেকে, যেখান থেকে ফেরা বেশ কঠিন। যেমন ছিল রেয়ালের। ০-২ পিছিয়ে, তিনগোলের ব্যবধানে জিততে হবে। পরিস্থিতি কঠিন হলে যাঁরা সহজে কাজের কাজ করে ফেলতে পারেন, জিনিয়াস তো তাঁরাই। নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ফেললেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। এক মরসুমে তিন-তিনটি হ্যাটট্রিক, তা-ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে! এবার দশ ম্যাচে ১৬ গোল! চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মোট ৯৩ গোল। আর নিজের ২০১৩-১৪ মরসুমের সর্বোচ্চ ১৭ গোলের রেকর্ড ভাঙার জন্য আরও দু'ম্যাচ হাতে!


'রেকর্ড ভাঙা নিয়ে ভাবতে ভালই লাগে। কিন্তু তার চেয়েও বড়, দলের যা প্রয়োজন, করতে পারা। পিছিয়ে থেকেও আমাদের খেলায় শুরু থেকেই ছিল জেতার তীব্র তাগিদ। শুরুতেই দুটো গোল পেয়ে যাওয়ায় প্রাথমিক চাপটা কমে গিয়েছিল।দু-পর্ব মিলিয়ে যোগ্যতর দল হিসাবে আমরাই সেমিফাইনালে', বলেছেন বের্নাবেউ-এর নায়ক। দিলেন নিজের ক্লাবকে 'উনদেসিমা' বা এগার বার ইউরোপে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা জেতার নতুন লক্ষ্যে এগিয়ে চলার প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস!

প্রথম গোল ১৬ মিনিটে। ডানদিক থেকে উঠে এসে কার্ভাহালের নিচু সেন্টার। উলফসবুর্গের ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডার দাঁড়িয়ে দেখলেন, যেতে দিলেন বলটা। দূর থেকে ফলোকরে এসে রোনালদো বিনা বাধায় পা ছুঁইয়ে গেলেন। তার ৯০ সেকেন্ডের মধ্যেই ২-২। এবার কর্নারে সবার মাথা ছাড়িয়ে উঠে হেডে। হ্যাটট্রিকের গোল ফ্রি-কিক থেকে। সামনে মানবপ্রাচীরে ফাটল! সেখান দিয়ে গলে গেল, এল রেয়ালের সেমিফাইনালে ওঠার ছাড়পত্র। তবে, যে-ফাউলের কারণে ওই গোল, ফাউল ছিল কি? মোদরিচের পা থেকে নিখুঁত ট্যাকলে বল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মোদরিচ পড়ে যান, রেফারি ফাউলের নির্দেশ দেন। কিন্তু, এমন অসম্ভবকে সম্ভব করার রাতে এইসব ছোটখাটো ভুল নিয়ে কে আর মাথা ঘামাবে!

ম্যাঞ্চেস্টার সিটির সুবিধা ছিল, অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে ২-২ নিয়ে ফিরেছিলেন আগেরোরা। ঘরের মাঠে আরও আগেই এগিয়ে যেতে পারত সিটি। কিন্তু আগেরো পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারেননি। ঠিক যেমনভাবে ইব্রাহিমোভিচ মিস করেছিলেন নিজেদের মাঠে, তার থেকেও খারাপ শট নিয়েছিলেন আগেরো। বল বাইরে। তাতে ক্ষতি ছিল না, অন্তত যতক্ষণ পিএসজি গোল না-পাচ্ছে। ইব্রা, দিমারিয়া, কাভানিদের দরকার ছিল জয়, এক গোলে হলেও। ইব্রার প্রচুর খ্যাতি আছে বিভিন্ন উপায়ে গোল করার ক্ষেত্রে। সেই গোলগুলো বিশেষ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু কাজের দিন কিছুই কাজে এল না। দিমারিয়া ম্যাঞ্চেস্টারেই এক বছর ছিলেন, তবে ইউনাইটেডে। ফিরলেন আবার একই শহরে খেলতে, ফিরে গেলেন সেই শূন্যহাতেই! লরাঁ ব্লাঁ-র দলকে কখনই মনে হয়নি, জেতার সেই তাগিদ নিয়ে খেলছেন যা নিয়ে যেতে পারত তাদের, ইউরোপের প্রথম চারে। তাই পেয়েগ্রিনি, এই মরসুমের পর যিনি সিটির দায়িত্ব ছাড়বেন, যাওয়ার আগে সিটিকে দিয়ে গেলেন নতুন ইতিহাস। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা চার দলের মধ্যে নাম তুলে।

তবে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টিকে-থাকা একমাত্র ইংরেজ ক্লাবের এমন কৃতিত্বের দিনেও প্রচারের সব আলো নিয়ে গেলেন সেই রোনালদোই। স্পেনে তাঁর সঙ্গে লিওনেল মেসির দ্বৈরথ গত সাত ভচর ধরে আলোচনার শীর্ষে। মঙ্গল-রাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর এই পারফরম্যান্সই কি জাগিয়ে তুলবে ৩৬২-মিনিট গোল না-পাওয়া মেসিকে, বুধ-রাতে আতলেতিকোর বিরুদ্ধে?


গোল্লাছুট ৮



Friday, March 25, 2016

তারপর আসেন জোহান ক্রুয়েফ, খেলাটাই পাল্টে যায়!




ফুটবল-ইতিহাস পরিষ্কার দু’ভাগে বিভক্ত। ক্রুয়েফের আগে, ক্রুয়েফের পরে! তাঁর মতো করে এমন প্রভাব রেখে যেতে পারেননি আর কেউ, লিখলেন

কাশীনাথ ভট্টাচার্য


Playing football is very simple, but playing simple football is the hardest thing there is.
                                        -          Johan Cruyff

প্রয়াত জোহান ক্রুয়েফকে সত্যিকারের শ্রদ্ধার্ঘ্য আলেখান্দ্রো দিমারিয়ার। মুখে নয়, গোলমুখে; বলে নয়, গোলে! চিলের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনা যে-গোলে ১-১ করল, ক্রুয়েফের নশ্বর শরীর নিঃশ্বাস নেওয়া থামিয়ে দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে।
বল পেয়েছিলেন বক্সে, ডানপায়ে। দিমারিয়া, সবাই জানেন, বাঁপায়ের ফুটবলার। যেখানে পেয়েছিলেন, বক্সে ঠিক উল্টোপাশে এমন জায়গায় বল পেলে লিওনেল মেসি বা আরিয়েন রবেনের বাঁ-পা ঝলসে ওঠে। দিমারিয়ার ডান পায়ে বিদ্যুৎ! বার্সেলোনা ও চিলের গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো শরীর ছুঁড়েছিলেন ঠিকই। জেনেই যে, গোল আটকাতে পারবেন না! তুলনায় যে-পায়ে জোর কম, দরকারে সেই পা-কেও কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, পায়ে-বলে দেখালেন দিমারিয়া।
ক্রুয়েফকে দু-পায়ের ফুটবলার গড়ে তুলেছিলেন আয়াক্সের জুনিয়র দলের ট্রেনার জানি ফন ডার ফিন। সহজাত ডান পায়ের ফুটবলার হওয়া সত্ত্বেও তাই বাঁপায়ে দুরন্ত শট নিতে পারতেন। পরে, কোচ হয়েও জোর দিতেন ফুটবলারদের কমজোরি পায়ের ব্যবহার বাড়ানোর দিকে। চমকে দিতেন বাঁপায়ের ফুটবলারদের ডানদিকে খেলিয়ে, ডান পায়ের ফুটবলারদের বাঁদিকে। আজ মেসিকে মাঠের ডানদিকে এবং নেইমারকে মাঠের বাঁদিকে খেলতে দেখতে অভ্যস্ত ফুটবল-বিশ্ব। শুরুটা করে গিয়েছিলেন ক্রুয়েফই। নিজের ছেলে জোর্দি ডানপায়ের ফুটবলার বলে তাঁকে বাঁদিকে সরিয়ে আদ্যন্ত বাঁপায়ের ফুটবলার স্তোইচকভকে খেলিয়েছিলেন ডানদিকে। বিপক্ষ বেঞ্চে অ্যালেক্স ফার্গুসনের নাভিশ্বাস! ৪-০ জিতেছিল বার্সেলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোচের ধাঁধা লেগে গিয়েছিল চোখে। পরে ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ফিরিয়ে এনেছিলেন ‘গুরু’-র কাছে শেখা সেই কৌশল। রোনালদিনিওকে বাঁদিকে এনেছিলেন, মেসি তখন থেকেই ডানদিকে। ক্রুয়েফকে গালাগাল দিতেও যে-মোরিনিওদের কখনও ভাবতে হয়নি দু-বার, সেই নিজ-মতে ‘স্পেশ্যাল’ কোচও সে-ধারণায় প্রভাবিত হয়ে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে মাঠের বাঁদিকে এনে ফেলেছিলেন! ক্রিস্তিয়ানো এখনও খেলেন বাঁদিকেই! ক্রুয়েফ যা করেছিলেন ১৯৯৪ সালে, আধুনিক ফুটবল সেই পথেই হাঁটছে এই ২০১৬ সালেও, হুবহু। ‘সুদূরপ্রসারী প্রভাব’ সংজ্ঞা ও উদাহরণসহ!

এই ২০১৬-ই মাসখানেক আগে খুঁজে পেয়েছিল তাঁকে, মেসি আর সুয়ারেজ যখন পেনাল্টিতে ‘ওয়ান-টু’ খেলেছিলেন! ক্রুয়েফ আর জেসপার ওলসেন এমনই করেছিলেন ১৯৮২ সালে, আয়াক্সের হয়ে, হেলমন্ড স্পোর্ট-এর বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, ইন্টারনেটের যুগে জানা গিয়েছে, ক্রুয়েফও সেই কাজে প্রথম নন। কিন্তু, তিনি যে সত্যিই প্রথম নন, এটা জানতেও তো ইউটিউব ভরসা! না হলে, বুকে হাত দিয়ে স্বীকার করবেন কি কোনও ফুটবলপ্রেমী, রিক কোপেন্স আর মাইক ট্রেবিলককের নাম জানতেন তাঁরা, মেসি-সুয়ারেজ ‘ট্যাপ পেনাল্টি’ নেওয়ার আগে? ক্রুয়েফের পেনাল্টির কথা অবশ্য জানতেন তাঁরা, অনেকেই।
পেপ গারদিওলা যে অন্ধের মতো অনুসরণ করেন ক্রুয়েফকে, রোজ তা পড়তে পারা যায় কোথাও না কোথাও, বিশেষত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাজার-এ। কিন্তু, ঠিক কোথায় কোথায় এবং কীভাবে? না, তার ঠিকানা নেই!
‘কান্তেরা’ স্পেনীয় ভাষার শব্দ, বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় খাদ বা খনি, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে আনতে হয়। বার্সেলোনায় এসে ক্রুয়েফ যে লা মাসিয়ার পত্তন করে গিয়েছিলেন, এখন অনেকেই জানেন। কিন্তু, শুধু পত্তনে তো হবে না, দেখতে তো হবে, কী কী তুলে আনা যায় সেই ‘কান্তেরা’ থেকে। রোনাল্ড কোয়েম্যান আহত, গিলারমো আমোর কার্ড দেখে নির্বাসিত, কী করবেন ক্রুয়েফ? কাকে খেলাবেন তাঁর বড় সাধের সেই জায়গায়, যেখান থেকে রক্ষণ আর আক্রমণের যোগসূত্র রক্ষা তো করতে হবেই, খেলাটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে অসামান্য দক্ষতায়? ‘কান্তেরা’ থেকে উঠিয়ে আনা হল পেপ গারদিওলা নামের সেই না-কাটা হীরেটাকে। এবার কেটে পালিশ করে তাঁকে বার্সেলোনা ও স্পেনের অধিনায়ক করে তোলার দায় সানন্দে কাঁধে নিলেন ক্রুয়েফ। অবিকল একই কাজ করেননি গারদিওলা নিজেও? ইয়াইয়া তোরে তখন কাম্প নৌ-তে জায়গা তৈরি করে ফেলেছেন। পেপ এসে ছেড়ে দিলেন তাঁকে। সবাই অবাক, আনকোরা কে এক সের্জিও বুসকেতস নাকি খেলবেন সেখানে! পেপ বার্সেলোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৮-০৯ মরসুমে। আজ বার্সেলোনাকে ছেড়ে দিন, স্পেনের মাঝমাঠও ভাবতে পারবেন না বুসকেতসকে ছাড়া! পরম্পরা নয়, শিক্ষা!

জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ আজও গারদিওলাকে সহ্য করতে পারেন না। সমালোচনাও করেন না, পরিষ্কারই গাল পাড়েন বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে যে, ‘কোচ নয় ওই লোকটা দার্শনিক হতে চেয়ে কী যে বলে মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারা যায় না!’ কারণ কী? সেই এক, কান্তেরা-র মেসিকে বেশি ভালবাসা, ভালবেসে মেসিকে মাঝখানে নিয়ে এসে ইব্রাহিমোভিচকে উইংয়ে ঠেলে দেওয়া। মনে পড়তে বাধ্য, গ্যারি লিনেকার নামের এক ফুটবলারের সঙ্গে ক্রুয়েফের সম্পর্কের কথা, আজ ক্রুয়েফ প্রয়াত হওয়ার পর যিনি বলেছেন, তাঁর চেয়ে বড় কোচ কমই দেখেছেন। সেই দিন কিন্তু লিনেকার বুঝেই উঠতে পারেননি, কেন তাঁকে মাঝখান থেকে ডানদিকে সরিয়ে দেওয়া হল আর হুলিও সালিনাসকে টেনে আনা হল মাঝখানে। ‘ক্রুয়েফ যে সিস্টেমের কথা বলেছিলেন, আমি হতে পারতাম আদর্শ সেন্টার ফরোয়ার্ড। কিন্তু, যাকে পছন্দ নয়, ক্রুয়েফের ধরন ছিল ওভাবেই তাকে সরিয়ে দেওয়া। খেলা থেকে সরে থাকতে হচ্ছে বলে আমি মাথা গরম করলে, সেই কাজে আরও সুবিধা ক্রুয়েফের। তাই-ই হল, আমি সরে এসেছিলাম।’ ইব্রা-র লিনেকার  সময় লিনেকারের সঙ্গেই আরও এক ফরোয়ার্ডও বেরিয়ে এসেছিলেন, কারেসকা, যার সঙ্গে স্যামুয়েল এতো-র তুলনা টানা যেতে পারে, গারদিওলার বার্সেলোনায়। তখন উঠে এসেছিলেন বোয়ান ক্রকিচ, ক্রিস্তিয়ান তেয়ো-রা, একইভাবে, ‘কান্তেরা’ থেকে! শুধু তাই-ই নয়, পরে যেমন রোমারিও এসে যোগ দিয়েছিলেন ক্রুয়েফের দলে, লুইস এনরিকের বার্সেলোনায় আজ নেইমারের পাশে এসেছেন লুইস সুয়ারেজও!
খেলা বা খেলানোর ধরনে যাওয়া যাক, মিল যেখানে সবচেয়ে বেশি। ক্রুয়েফের সিস্টেমটা ঠিক কী?
ক্রুয়েফ-সিস্টেম নির্ভরশীল গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকার ওপর, যার মূলে থাকবেন সেন্ট্রাল-অ্যাক্সিস হিসাবে সেন্টার ফরোয়ার্ড আর ‘ফ্রি’ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মধ্যে সম্পর্ক রাখার দায়িত্ব যাঁর। মার্কো ফন বাস্তেন তাকেই বলতেন ‘অদৃশ্য সূতো’। এই চূড়ান্ত অক্ষে অন্য আরও যাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গোলরক্ষক আর দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। বাকি ফুটবলাররা প্রকৃত অর্থেই ‘ফ্রি’। তাদের মধ্যে দুজন উইঙ্গার, খেলবেন টাচলাইন ধরে। রক্ষণের দুই সাইড ব্যাক ও মাঝমাঠের দুপাশে দুজন ক্রমাগত নজর রাখবেন প্রান্ত ধরে দৌড়ে ওঠার দিকে, কখনও আবার বিপক্ষের প্রান্তিক দৌড় বন্ধ করার দিকে। সার্বিকভাবে এই সিস্টেম দিয়েছিল আক্রমণে সারাক্ষণ ওঠার মানসিকতা, গতিময়তা, একই সঙ্গে বল ধরে খেলে যাওয়ার শিক্ষা। ক্রুয়েফ যা বলতেন, লিও মেসির টুইটার-দল তাকে তুলে ধরেছে, ‘মাঠে বল যেহেতু একটাই, নিজের দখলে রাখাটাই শ্রেয়।’
বার্সেলোনার ‘ড্রিম টিম’-এর খেলা যাঁরা দেখেননি, কিন্তু গারদিওলা ও এনরিকের বার্সেলোনা এবং গারদিওলার বায়ার্ন মিউনিখকে যাঁরা দেখেছেন, বলে বোঝানো জরুরি নয় যে, মিল ঠিক কতখানি এবং কোথায় কোথায়! জাভি এরনান্দেজ বার্সেলোনায় ছিলেন মুখ্য সঞ্চালকের ভূমিকায়, এখন যা ইনিয়েস্তার দায়িত্বে। গোলরক্ষক হিসাবে প্রথমে ভালদেস, পরে ব্রাভো বা টের স্টেজেন, বায়ার্নে নয়ার, আক্রমণ শুরুর ভূমিকায়। লম্বা শটে বিপক্ষের বক্সে পাঠানোর অযথা অর্থহীন তাড়াহুড়ো নয়, হাত দিয়ে ছোট ছোট পাস যেন, দুই স্টপারের কাউকে। স্টপার দুজন সরে যাচ্ছেন দুপাশে, উইংব্যাকদের সুযোগ দিচ্ছেন ওপরে ওঠার, দুই উইংয়ে নেইমার-মেসি এখন বার্সেলোনায়, বায়ার্নে রবেন-রিবেরি টাচলাইন ছেড়ে ভেতরে ঢোকেন তখনই যখন গোলর গন্ধ নিশ্চিতভাবেই পেয়ে গিয়েছেন। সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসাবে আগে মেসি ছিলেন, এখন সুয়ারেজ বার্সেলোনায়, বায়ার্নে লেওয়ানডোস্কি। পেছন থেকে ঠিক যেমন ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করেছিলেন, মেসি বা মুলার চলে আসছেন গোলের সামনে যখন, বিপক্ষ রক্ষণে ত্রাহি ত্রাহি রব। আর শুধু বার্সেলোনা বা বায়ার্নই কেন, লরাঁ ব্লাঁ-র পিএসজি-কেও দেখুন না, একেবারে এক ছক। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে যে চারটি দল সত্যিই ভাল ফুটবল খেলছে, যাঁদের খেলা মানেই বলটাকে কোনও রকমে লম্বা শট মেরে বিপক্ষের বক্সে বা তার আশেপাশে পাঠিয়ে দেওয়া নয় – সেই তিনটি দলই অবিকল ক্রুয়েফ-সিস্টেম মেনে চলছে, খেলছে, আনন্দ দিচ্ছে দর্শকদের।

ক্রুয়েফ সম্পর্কে আলোচনায় রাইনাস মিশেলকে আসতেই হবে কারণ তিনি ছিলেন ক্রুয়েফের গুরু। আর সেই আলোচনা এলেই যে শব্দবন্ধ বাংলা কাগজে উঠে আসে, ‘টোটাল ফুটবল’। সমস্যা হল, না মিশেল না ক্রুয়েফ, কেউ কখনও নিজেদের ফুটবল খেলার ধরনকে ‘টোটাল’ বলেননি! মিশেল বরাবরই বলে এসেছেন, ‘প্রেসিং’। তাঁর আয়াক্সের খেলার ধরন এক ফুটবল সাংবাদিককে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, তিনিই তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনে এই ‘টোটাল ফুটবল’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে প্রচলিত হয়ে যায়। মিশেল পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘চেয়েছিলাম প্রেসিং ফুটবল। যেখানে বলের দখল হারানো মাত্র ফুটবলাররা তাদের সামনের ফুটবলারদের ওপর প্রেস করবে, মানে চাপ দেবে, বলের দখল ফেরত পেতে। তখন আক্রমণভাগের ফুটবলারকেও হয়ে যেতে হবে ডিফেন্ডার, যেহেতু সে বলটা কেড়ে নিতে চাইছে।’ ফুটবলারদের সার্বিক দক্ষতা অবশ্যই বাড়াতে হত, সেই কারণেই মিশেল ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলার ওপর কড়া নজর রাখতেন। ফুটবলারদের সবার শারীরিক দক্ষতা একটা নির্দিষ্ট মানে না-পৌঁছলে এই খেলা ৯০ মিনিট ধরে খেলে যাওয়া, গোটা মরসুম জুড়ে খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে, প্রাক-মরসুম অনুশীলন খুব গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে মরসুম জুড়ে একইভাবে খেলে যাওয়ার জন্য রোটেশনও গুরুত্বপূর্ণ। নিউক্লিয়াস চিহ্নিত করা এব তাদের ধরে রাখা। বেশ কঠিন কাজ। এই তীব্রতা ৫০-৫৫ ম্যাচের মরসুম জুড়ে দেখিয়ে যাওয়া পারফরম্যান্সে, প্রায় অসম্ভব স্তরের কাজ। যাঁরা করতে পারেন, ফুটবল তাঁদের জন্য সত্যিই সুন্দর। বাকিরা ওড়াবেন!
ক্রুয়েফের জীবন তবুও শুধুই প্রাপ্তির খাতায় উপচে-পড়ার ইতিহাস নয়। নিজের দল, আয়াক্স আমস্টারডম ও সেই দলের সতীর্থরা সবাই মিলে তাঁর হাত থেকে অধিনায়কত্ব নিয়ে নেওয়ার দাবিতে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। সেই সময় ক্রুয়েফ মানে আয়াক্সকে তিনবার ইউরোপ-সেরা করেছেন, তারপরও! তাঁর নামে উঠেছিল ‘বড্ড বেশি টাকা চেনেন’ এই অভিযোগও। বার্সেলোনায় এসে প্রথম মরসুমে দুরন্ত সাফল্য, রেয়াল মাদ্রিদকে ৫-০ হারানোর পরের তিন বছরে আর মাত্র একটি ট্রফিই দিতে পেরেছিলেন। নেদারল্যান্ডস-এর হয়ে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানদের অপদস্থ করতে গিয়ে আরও বেশি গোল না দিতে পেরে শেষে নিজেদেরই হার। বার্সেলোনায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে এসি মিলানের কাছে ০-৪। শেষে বার্সেলোনা থেকেই কোচ হিসাবে শেষ দু-বছরে ট্রফি দিতে না-পেরে হতাশাজনক বিদায়। ক্রুয়েফের জীবনেও অপ্রাপ্তি কিছু কম নয়।
কিন্তু, ট্রফির সাফল্য মরসুম শেষে আর ইতিহাস বইতে থাকে। যা থেকে যায়, অবিশ্বাস্য প্রভাব। পরের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারা সৃষ্টিশীলতায়, সৌন্দর্যে। তাঁর পর গারদিওলা এবং এনরিকে ছাড়া আর কোনও ফুটবলার ক্লাব কোচিংয়ে এসে এত সাফল্য পাননি। এবং তাঁর এই দুই ছাত্রও সবে শুরু করেছেন বলাটাই ঠিক যেমন, ফুটবলার হিসাবে তাঁরা কেউই ক্রুয়েফের দশ মাইলের মধ্যে আসারও যোগ্য নন, নিজেরাই জানেন। প্রথম ‘ইউরোপীয়’ ফুটবলার হিসাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তারকা, ক্রমশ বিশ্বেও। কোচ হয়ে ক্লাব ফুটবলে প্রতি সপ্তাহে নিংড়ে-নেওয়া চাপ নিরন্তর সহ্য করেননি বেকেনবাওয়ারও। আবার ফুটবলার হিসাবে পেলে বা মারাদোনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়নি কোনও নির্দিষ্ট শব্দ, যেভাবে হয়েছে ‘ক্রুয়েফস টার্ন’।
ওয়ার্ল্ড সকার একবার ফুটবল ইতিহাসের সেরা কুড়ি দল বেছে নিয়েছিল। একমাত্র ফুটবলার ও কোচ হিসাবে ক্রুয়েফের তিনটি দল ছিল সেই সেরা তালিকায়। ১৯৭৪-এর নেদারল্যান্ডস, ১৯৭১-৭৩ আয়াক্স আমস্টারডম ও বার্সেলোনার স্বপ্নের দল। পেলের ১৯৭০ ব্রাজিল ও ১৯৫৮ ব্রাজিল ছিল, কিন্তু, তৃতীয় কোনও দল জায়গা পায়নি সেই তালিকায়।

সবাই খেলেন। তারপর আসেন জোহান ক্রুয়েফ। খেলাটাই পাল্টে যায়!
ফুটবল-ইতিহাস পরিষ্কার দু’ভাগে বিভক্ত। ক্রুয়েফের আগে, ক্রুয়েফের পরে! তাঁর মতো করে এমন প্রভাব রেখে যেতে পারেননি আর কেউ।

এক এবং অনন্য ছিলেন, থেকেই যাবেন ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’ জোহান ক্রুয়েফ!