Wednesday, October 28, 2015

রোবের্তো কার্লোস দেখালেন, ‘উত্তম’-রা নিশ্চিন্তেই চলেন নওবাদের সঙ্গে, চিরকাল!


কলকাতায় আইএসএল-এর সাংবাদিক
সম্মেলনে কার্লোস

কাশীনাথ ভট্টাচার্য


মানুষ বড় হ্য় স্বভাবে, আচরণে।
‘লাগে রহো মুন্নাভাই’ দেখেছিলেন? রেডিও জকি হিসেবে মুন্নাভাই তখন শেখাচ্ছিলেন গান্ধীগিরি। এক কন্যা রেস্তোরাঁয় বসে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভাবী বর আসছে দেখা করতে, কিন্তু এক-দু’মিনিটে কী করে বুঝব সে আসলে কেমন? ওইটুকু সময়ের জন্য এসে সে তো ভাল ব্যবহারই করবে, তাই না?’
পর্দার মহাত্মার পরামর্শে মুন্নাভাইয়ের তাৎক্ষণিক জবাব, ‘মানুষকে পরখ করতে গেলে দ্যাখো, নিজের চেয়ে যাদের সামাজিক অবস্থান নিচে তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে। মানে, যদি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারকে শিস্ দিয়ে ডাকে, বা মুখ দিয়ে চুচুচু আওয়াজ করে, ওখান থেকে পালিয়ে যেও!’
রোবের্তো কার্লোস ফুটবল বিশ্বে বিশেষ পরিচিত। এখানে, বিশ্ব মানে ২০৭ দেশ কমপক্ষে, সাত দেশের বিশ্ব নয়! নওবা সিং কে, ১৩০ কোটির মধ্যে এক কোটি ভারতীয় খুব বেশি হলে বলতে পারবেন। তাঁকে পাশে নিয়ে আইএসএল-এর সাংবাদিক সম্মেলন। যখন সব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ধাবিত কার্লোসের দিকে, বারবার অনুরোধ, নওবা-কে প্রশ্ন করার জন্য। তাঁকে অনেকগুলি প্রশ্নের পর যখন প্রথম প্রশ্ন গেল নওবার দিকে, নিজের সামনে-থাকা মাইক্রোফোন সুইচ টিপে বন্ধ করলেন, বাঁ হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিলেন নওবার সামনের মাইক্রোফোনের আলো। তাতেও অস্বস্তিতে নওবা যখন কথা বলছেন আস্তে আস্তে, নিজের মাইক্রোফোন ‘অন’ করে এগিয়ে দিলেন নওবার দিকে, এমনকি, নওবার মাইক্রোফোনও এগিয়ে এনে দিলেন নওবারই মুখের কাছাকাছি। পাশে-বসা অনুবাদককেও বলে দিলেন নওবাকে বলতে যে, যেন মুখটা মাইক্রোফোনের কাছে এনে কথা বলে। এবং, শেষে নিশ্চিত করে দিলেন যে, তিনি আর কোনও কথা বলবেন না, দেবেন না কোনও প্রশ্নের উত্তর, বাকি সব প্রশ্নই যেন করা হয় নওবা-কেই!
কোচ বলে তাঁকে এমন করতেই হত, বাধ্যবাধকতা ছিল না, নেই। অন্য কোচরাও এমন করতেন তা হলে। কই করেন না তো!
সহজাত অপত্যে মুগ্ধ করে আরও একবার বুঝিয়ে গেলেন রোবের্তো কার্লোস, ‘উত্তম’-রা নিশ্চিন্তেই চলেন নওবাদের সঙ্গে, চিরকাল!

*****
তিনি তখন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে!
জিনেদিন জিদান বাড়িয়েছিলেন বল, মাথার ওপরে। দুরন্ত রিসিভ থিয়েরি অঁরির। এবং বক্সে ওই জায়গায় পায়ে-বলে ঠিকঠাক হলে যা হয়, গোল করতে ভুল করেননি অঁরি। আর ওই গোলেই বিদায় ব্রাজিলের, ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে, কোয়ার্টার ফাইনালে।
রোবের্তো কার্লোস পরিষ্কার জানালেন, ওগুলো আর মনে রাখতে চান না। ‘ট্রফি হাতে ছবি, মনে রাখার মতো ব্যাপার। সেই ছবিও প্রচুর তুলেছি। ওগুলোই মনে রাখতে চাই। যেখানে হেরেছি, শুধু শুধু মনে রাখতে যাব কেন?’
অবশ্য পরেই বিশ্লেষণও করলেন। ‘ওই বিশ্বকাপে আসলে আমরা গিয়েছিলাম খুব ক্লান্ত হয়ে। রোনালদিনিও, কাকা, আমরা সবাই। তা ছাড়া, বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতিও ঠিকঠাক হয়নি। ফুটবল ওভাবে তো হয় না! প্রচুর খেলতে হয়েছিল ক্লাবের হয়ে। প্রায় বিশ্বকাপের আগে পর্যন্তই। প্রভাব পড়েছিল খেলায়। কিন্তু, ওগুলো আসছে কেন? তার আগের বিশ্বকাপ ভাবুন। রোনালদোর ওই অসাধারণ খেলা, রিভালদোর, আমাদের সবার। বিশ্বকাপ হাতে ছবি। মনে রাখার জন্য এর চেয়ে ভাল আর কী!’
ঠিকই বলেছিলেন হয়ত নিজেদের দিক দিয়ে। রোনালদিনিও সেই ২০০৬ নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন বার্সেলোনায়। লা লিগা তো বটেই, এনে দিয়েছিলেন বার্সার দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ফাইনালে আর্সেনালকে হারিয়ে। তখন বার্সেলোনা পরে পেপ গারদিওলার আমলের জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসি-অঁরি-এতোর মতো নয়। একা রোনালদিনিওকেই টানতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। এতো-গিউলি-দেকোদের নিয়ে, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডের আমলে। মেসি আহত থাকায় খেলতে পারেননি, এমনকি জায়গা পাননি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দলেও। বিশ্বকাপের আগে রোনালদো ছিলেন অসুস্থ। খেলতে পারবেন কিনা, সংশয় ছিল। প্রায় জোর করেই রোনালদোকে খেলানো হয়েছিল, বিশ্বকাপে জার্ড মুলারের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভাঙার জন্য, যা শেষ পর্যন্ত ভেঙেও ছিলেন। এবং যে রেকর্ড নিজের দেশে অনুরূপ পরিস্থিতিতে ভাঙতেও দেখেছিলেন রোনালদো, আর এক জার্মান মিরোস্লাভ ক্লোজেকে!

*****
তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। ১৯৯৮, ২০০২ এবং ২০০৬। তিনটি ম্যাচ হেরেছিলেন বিশ্বকাপে। একবার নরওয়ের কাছে, ১৯৯৮ গ্রুপ লিগে। বাকি দুবারই বিপক্ষে ফ্রান্স এবং জিনেদিন জিদান! ১৯৯৮ ফাইনালে হেডে জিদানের দু-গোল, শেষে ০-৩ হার ফাইনালে। আট বছর পরেও জিদানের পাসের কাছে হার। সেই জিদানই আবার সতীর্থ, রেয়াল মাদ্রিদে। ২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সেই রোবের্তো কার্লোসের উঁচু করে তোলা বল মাটিতে পড়তে না-দিয়ে সরাসরি বাঁ পায়ের ভলিতে গোল জিদানের এবং রেয়ালের ইউরোপে নবম খেতাব। উয়েফার বিচারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। তাই সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছেন এমন সেরা ফুটবলার বেছে নিতে গিয়ে জিদান সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হবেন রোবের্তো, আশ্চর্যের কিছু নেই।
‘অনেকের সঙ্গে ও বিপক্ষে খেলেছি। আমাদের গালাকতিকোস ছিল। জিদান, রোনালদো, ফিগো, রাউল, বেকহ্যাম, কাসিয়াস, আমরাও ছিলাম। প্রত্যেকে দুর্দান্ত ফুটবলার। খেলার আনন্দ উপভোগ করেছি চুটিয়ে। আসলে কী বলুন তো, পেলে-মারাদোনা-রোনালদো-জিদান কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। ওঁরা একবারই আসেন, মাতিয়ে দিয়ে যান ফুটবল বিশ্বকে। হ্যাঁ, তবুও আলাদা করে জিদানের কথা বলতেই হবে। খেলেছি, সঙ্গে যেমন, বিপক্ষেও। অন্যরকম, আলাদা সবার চেয়ে।’
স্বপ্ন খুন যাঁর মাথায় ও পায়ে দু-দু’বার, অকৃত্রিম বন্ধু হলেও তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে কার্লোস সিলমোহর দিলেন চিরন্তন সত্যে যে, পরাজয় স্বীকার না-করতে জানলে জয়ী হওয়া যায় না কখনও।
আর, তাঁর চোখে সেরা লেফট ব্যাক? সরাসরি না বললেও নাম করলেন পাওলো মালদিনির। ‘অমন আর কে? পেলে-মারাদোনা-জিদানদের মতোই মালিদিনিও একজনই, একবারই আসে।’
সইও দিলেন কার্লোস

*****
বঙ্গ ফুটবল-বাজারে এমনকি ব্রাজিলেও পেলে নাকি তেমন জনপ্রিয় নন, এমন এক হাওয়া অত্যন্ত সুকৌশলে বিশেষ বিশেষ মিডিয়ার দৌলতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত। ব্রাজিল যাওয়ার সুবাদে সেই ভাবনা যে ঠিক কতখানি অলীক, প্রমাণ পেয়েছিলাম। এবং এখন যখন ব্রাজিলীয় গ্রেটরা নিয়মিত আসছেন আমাদের এই পোড়া দেশেও, বারবার শোনা ও দেখা যাচ্ছে, কীভাবে ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশেয়ে এবং নিজ নিজ ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যসিদ্ধির কারণে উল্টোপথে চালিত করতে চেয়েছিলেন বঙ্গজ ফুটবল মিডিয়ার সেই দিগগজরা!
কয়েকদিন আগেই পেলে এসে বলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, এখনকার ব্রাজিলে ব্যক্তিদক্ষতার কমতি নেই, খামতি যা আছে দলগত খেলায়। পেলে কি ঠিক বলেছিলেন, জানতে চাওয়ায় কার্লোস দ্বিধাহীন স্বরে জানিয়ে গেলেন, ‘পেলে ফুটবলের রাজা। আর, রাজা কখনও ভুল হতে পারেন না। যা বলেছেন ওঁর মত। তার মতের ওপর কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, চাইও না। নিশ্চয়ই ওঁর মনে হয়েছিল তেমন। তাই বলেছিলেন। আমি আর কী বলতে পারি?’


ভবিষ্যতে পেলে-সম্পর্কিত বাংলা কাগজের প্রতিবেদনে গুঁজে-দেওয়া বিশেষ মন্তব্যগুলো পড়ার সময় আর একবার আলাদা করে ভেবে নেওয়া উচিত বোধহয় এবার!

Tuesday, October 27, 2015

ইঞ্জিনীয়ারের ফুটবল প্রেম ও বেস্ট-ফার্গুসন


কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক তাঁবুতে ফারুখ ইঞ্জিনীয়ার, সোমবার সন্ধেয়

 কাশীনাথ ভট্টাচার্য


  • তিনি গলফ খেলেন অ্যালেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে!
  • তাঁর পাঁচটা বাড়ি পরে থাকেন ববি চার্লটন!
  • গর্ডন ব্যাঙ্কসের বাড়িতে এক পার্টিতে তাঁর আলাপ হয়েছিল পেলের সঙ্গে, বছর চল্লিশ আগে।
  • জর্জ বেস্টকে তিনি খেলতে দেখেছেন। তাই গড়পড়তা ব্রিটিশদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করেন, বেস্ট-ই ছিলেন ‘দ্য বেস্ট’!

সমস্যা একটাই, তিনি মোটেও বিখ্যাত ফুটবলার নন! ফুটবলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের মতোই, ‘গ্যালারি হইতে’, অথবা টিভি-তে চো্খ রেখে। তবে, বিখ্যাত তিনি অবশ্যই। ভারতের অন্যতম সফল উইকেটকিপার ও ব্যাটসম্যান, ফারুখ ইঞ্জিনীয়ার।
বয়স তাঁর ৭৭, জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮। প্রথম টেস্ট ১৯৬১ সালে, ৪৬তম ও শেষ টেস্ট ১৯৭৫-এ। আর, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৬ খেলেছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ার-এর হয়ে, কাউন্টি ক্রিকেটে।
তখন ল্যাঙ্কাশায়ারের মতোই রমরমা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-এরও। ‘বুসবি বেবস’ ইউরোপ জয় করেছিল ১৯৬৮ সালেই। জর্জ বেস্ট, ববি চার্লটনরা বেনফিকাকে হারিয়ে স্বপ্ন সফল করেছিলেন ব্রিটিশদের। আর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড দেখিয়েছিল উত্তরণ, মিউনিখে ১৯৫৮-র সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার (যে-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মোট ২৩ জন) দশ বছরের মধ্যে ম্যাট বুসবির প্রশিক্ষণে ইউরোপ-সেরা হয়ে। তার দু-বছর আগেই দেশের মাঠে বিশ্বকাপও জিতেছিল ইংল্যান্ড। ইংরেজ ফুটবলের সেই সেরা সময়েই ম্যাঞ্চেস্টারে হাজির হয়ে ফুটবল-ভক্ত তো হতেই হত ইঞ্জিনীয়ারকে!
‘তখন ইংল্যান্ডে প্রধানত খেলত ইংরেজ ফুটবলাররাই। তাই সময়টা ভাল ছিল। এখন দেখুন, প্রিমিয়ার লিগে সব বিদেশি ফুটবলার। ম্যাঞ্চেস্টারে দুটো এত বড় বড় ক্লাব – ইউনাইটেড আর সিটি। কিন্তু, ক’টা ইংরেজ ফুটবলার আছে দু’দলে? আর শুধু ওই দুটো দলেই তো নয়, গোটা প্রিমিয়ার লিগেই এখন খেলছে বিদেশি ফুটবলাররা। তাই তো ইংল্যান্ডেরও এই দুরবস্থা দেশের প্রতিযোগিতাগুলোয়। আর আমার সাধের ম্যাঞ্চেস্টারেরও (ইউনাইটেড)’, বলছিলেন কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক তাঁবুতে, সাংবাদিক সম্মেলনে।
অ্যালেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে গলফ খেলার অভিজ্ঞতা?
সাতাত্তরের ‘চনমনে’ বুড়োর দিলখোলা হাসি। ‘আরে বাবা, স্কটিশ তো। স্বভাব যাবে কোথায়? হারলে নিজের ব্যাগ থেকে বের করবে সবচেয় সস্তা বোতলটা, আর জিতলে মদ্যপান করাতে নিয়ে যাবে সবচেয়ে দামী বারে!’
ওল্ড ট্রাফোর্ডেই তো বেস্টকে খেলতে দেখা। চাক্ষুষ সেই অভিজ্ঞতায় এখনও বুঁদ ইঞ্জিনীয়ার। ‘গোল দেবে বলে দূর থেকে শট-ফট নেওয়ার বালাই ছিল না। ডিফেন্ডার আসছে, পাসও দিত না পাশের জনকে। কাটাত, ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে, ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে শেষে গোলকিপারকেও কাটাত, ফাঁকা গোলে ঠেলে দিত বল। ওটাই কনফিডেন্স! এখন তেমন কে আর? তখনই কেউ ছিল না তো এখন! বাঘা বাঘা প্লেয়াররা তখন দলে। তাঁরাই পারত না। ববি চার্লটন আমার পাঁচটা বাড়ি পরে থাকে। তখন বেস্টের সঙ্গেই খেলত ম্যাঞ্চেস্টারে। কিন্তু বেস্ট-ই বেস্ট, তুলনাহীন।’ বোঝা যায়, তিনি বহু বছর ধরেই থাকেন ইংল্যান্ডে, ম্যাঞ্চেস্টারেই। পড়েন বেস্ট-সংক্রান্ত ইংরেজদের উচ্ছ্বাস ও হাহুতাশের গল্পগুলো, নিয়ম করেই!
‘এত বিদেশি খেলে ওখানে, ভাবি একদিন যদি কোনও ভারতীয় ফুটবলারও খেলতে যায় ও-দেশে, কী হবে ভাবুন তো! ওরা কিন্তু খোঁজে। আমাদের দেশ থেকে যদি ততটা প্রতিভাবান কেউ খেলতে যায়, সব দিক দিয়েই উপকৃত হবে ভারতীয় ফুটবলও।’
সে কি আর আগামী বছর পঞ্চাশে সম্ভব? পারে, যদি ইংল্যান্ডে থাকেন এমন কোনও ভারতীয়র সন্তান কখনও ফুটবলকে পেশা করে এগিয়ে যায়। ঠিক যেভাবে ভারতের সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি খবর হয়েছিলেন ১৪ বছরের ইয়ান ধান্দা, লিভারপুলে সই করে।
কিন্তু, লক্ষ্মীপুজোর সন্ধেয় বেশ ঘরোয়া পরিবেশে ইঞ্জিনীয়ারের ফুটবল আলোচনা মনে থেকে যাবে অনেক দিন!

Saturday, October 24, 2015

পেলে ৭৫ - সানতোস এখন যেমন


 আমরা ভারতীয়রা ভাবতেই পারব না  এমন! এত সম্মানিত কারও নামের ওপর পা ফেলে চলে যাবে নশ্বর কোনও মানুষ, প্রশ্ন তুলব। কিন্তু, সানতোস-কর্তৃপক্ষ এভাবেই দেখিয়েছেন যে, ‘এই পথে হেঁটেই আমি পেলে হয়েছিলাম’! সানতোস ক্লাবের বারান্দায় এভাবেই খোদিত সেই সব ফুটবলারদের নাম যাঁরা গর্বিত করেছেন ফুটবলকে। মন্দির ভেবে নিলে পা ফেলতে হবে দেখেশুনে। অবশ্য, এমন মন্দিরই বা আর কোথায় যেখানে সাক্ষাৎ অধিষ্ঠান ফুটবল-ঈশ্বরের! 
কাশীনাথ ভট্টাচার্য


বলা হচ্ছে, পেলে আজ পঁচাত্তর। ঠিক কি?
জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। অর্থাৎ, ৭৫ পূর্ণ করে আজ ছিয়াত্তরে পা দিলেন ফুটবল-সম্রাট। তবে, অনাবশ্যক বিতর্কে ঢুকে লাভ কী! আজকের দিন তো উৎসবের। লিখেই বা হবে কী? পেলে সম্পর্কে দুনিয়া জুড়ে এত লেখা, এত নামীদামি মানুষ বলেছেন, লিখেছেন। আলাদা করে লিখে প্রমাণেরও কিছু নেই।

গ্যালারির এই অংশে ধরে রাখা হয়েছে ‘সময়’! যখন পেলে খেলতেন, যেভাবে দর্শকাসন চিহ্নিত হত সানতোসের মাঠে, আজও ঠিক সেভাবেই রাখা আছে, সযত্ন
বলা হয়, একটা ছবি নাকি হাজার লাইনের চেয়েও বেশি কথা বলতে পারে। কিছু ছবি তা-ই দেওয়া থাক। গত বছর, ২০১৪-র জুলাই মাসে, এক বরিষণমুখরিত সকালে গিয়েছিলাম সানতোসে। সেই মাঠ আর সানতোসে পেলের জাদুঘর দেখতে। বিশ্বকাপ শুরুর সময় যে জাদুঘর বন্ধ ছিল, খুলেছিল বিশ্বকাপের মাঝামাঝি। সেই সকালের কিছু ছবি।

কালো গ্যালারিতে সাদা চেয়ার এমনভাবে সাজানো, ফুটে উঠেছে ক্লাবের নাম। ভারতে কবে আমরা দেখব এমন?

আর হ্যাঁ, ধরে নিলাম না হয়, পেলে আজ ৭৫। বাঙালি বিরাট সম্মান দিতে পারে পেলেকে, আজ থেকে ‘স্যান্টোস’ বলাটা ছেড়ে দিয়ে। কালো মানিক-কে সাদাদের উচ্চারণে দেখবেন না, প্লিজ!

সানতোসের সেই মাঠ এখন ঠিক যে রকম

Wednesday, October 21, 2015

নয়ারের কারচুপির চেষ্টা ধরা পড়ল এবার!


বল গোললাইন পেরিয়ে গিয়েছে তো কী! নয়ার এভাবেই বের করে পরে রেফারির দৃষ্টি আকর্ষঁণ করতে চেয়েছিলেন
কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ম্যানুয়েল নয়ার এমন করেই থাকেন। পার্থক্য শুধু, অন্য দিন অন্য রেফারির হাতে পার পেয়ে যান, মঙ্গলবার রাতে আর পাননি!
দু-দু’বার বিশ্বকাপে তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ঠিক যে-অর্থে দিয়েগো মারাদোনা, থিয়েরি অঁরি বা ওলিভিয়ের জিরু ভণ্ডামি করেছেন, প্রতারণা করেছেন ফুটবলের সঙ্গে, নয়ারও করেছেন। ২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলায় ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের শট গোললাইনের ভেতরে পড়েছিল দু-দু’বার। নয়ার দেখেছিলেন স্পষ্ট। কিন্তু, দ্বিতীয়বারও গোললাইনের ভেতরে পড়ে বল যখন তাঁর আয়ত্তে আসে, জোরে শট করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি অঞ্চলে, অস্বাভাবিক দ্রুততায়। যাতে রেফারির মনে কোনও সন্দেহ তৈরিই না হয়! ইংল্যান্ড তখন ১-২ পিছিয়ে ছিল। ল্যাম্পার্ডের গোল মানে ২-২। তারপরেও জার্মানি জিততেই পারত, ৪-২ জিতত, কোনও অসুবিধে ছিল না তো! দল হিসেবে জার্মানরা নাকি সব সময়েই এগিয়ে থাকেন। তা-ও ইংল্যান্ডের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে দুধু-ভাতু দলকে হারাতেও রেফারির সাহায্য নিতে হয়েছিল। নি্যেছিলেন নয়ার। মঙ্গল রাতেও চেষ্টা করেছিলেন, হাততুলে দৃষ্টি আকর্ষণের। রেফারি অবশ্য তাঁকে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ দেখেননি, ঠিকই করেছেন!
ল্যাম্পার্ডের শট এতটাই ভেতরে পড়েছিল, একবার নয়, দুবার। নয়ার কিন্তু বলটা ধরেই শট মেরে বিপক্ষ বক্সে পাঠিয়েছিলেন!
গত বিশ্বকাপের পর চার বছর এগিয়ে আসুন। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল। এবার নয়ার হয়ে গিয়েছিলেন কিক-বক্সার! ৫৬ মিনিটে, নিজেদের বক্সের ঠিক বাইরে। লাফিয়ে ঘাড়ে উঠেছিলেন গোনজালো ইগুয়াইনের, হাঁটু দিয়ে মেরেছিলেন ইগুয়াইনের মুখে। সেই ছবিও ইন্টারনেটে সহজলভ্য। ওয়ার্ল্ড সকার পত্রিকা লিখেছিল, No excuse to ignore Neuer’s final thuggery.
লেখক পল গার্ডনার যা লিখেছিলেন, খুব সামান্য অংশ, ‘A terrible decision – the worst I have seen in a World Cup final. A decision that, … , allowed a goalkeeper to get away with actions that should have been punished.  Germany’s Manuel Neuer was the goalkeeper in question… Neuer had gone in with his right knee raised and he had jumped high enough for that battering-ram of a knee to smash into Higuain’s head.
মারাকানায় প্রেস বক্সে যেখানে বসেছিলাম সেই ফাইনালে, ঠিক সামনেই ঘটেছিল। চিৎকার করে উঠেছিলাম সেই বর্বরতায়, যা তুলনীয় ছিল একমাত্র আরও এক জার্মান গোলরক্ষক টনি শুমাখারের ক্যারাটে, ফরাসি বাতিস্ত্ঁর মুখে, ১৯৮২ বিশ্বকাপে। সেইবারও রেফারি দেখেননি। জার্মান গোলরক্ষকরা এভাবে মারলে অন্যদিকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকেন রেফারিরা, ইতিহাস সাক্ষী। লাল কার্ড প্রাপ্য ছিল যে ফাউলে, রেফারির বাঁশি দুবারই বাজেনি, এমনকি ফাউলের সিদ্ধান্ত দিতেও। হিটলারের দেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন মুসোলিনির দেশের রেফারি!
২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে নয়ারের কিক-বক্সিং!
হ্যাঁ, জার্মানরা একবার হেরেছিলেন রেফারির সিদ্ধান্তে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে, ইংল্যান্ড জোর করে হারিয়েছিল, জিওফ হার্স্টের শট গোললাইন পেরয়নি, কিন্তু, ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে ওই সিদ্ধান্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিতে হলে কলজের যে-জোর লাগে, রেফারিদের সচরাচর তা থাকে না, ১৯৬৬ সালে তো আরও ছিল না! ২০১৪ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার হুনিগা যখন পেছন থেকে নেইমারের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিলেন, রেফারি কিন্তু আয়োজক দেশকে ফাউলও দেননি!
এ ছাড়া, প্রতিবার জার্মানদের ছাড় দিয়েছেই রেফারিরা, বিশ্বকাপে, বিশ্বের নানা প্রান্তে। ১৯৫৪য় ফেরেঙ্ক পুসকাসকে মেরে প্রতিযোগিতার বাইরে করে দেওয়ার চেষ্টা। ১৯৭৪-এ নিজেদের দেশে পূর্ব জার্মানির বিরুদ্ধে ইচ্ছে করে হেরে তুলনামূলক সহজ গ্রুপে গিয়ে সোজা ফাইনালে যাওয়া। ১৯৮২-তে আলজেরিয়াকে বের করে দেওয়ার জন্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দৃষ্টিকটু গড়াপেটা। ১৯৯০-তে ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে মাঠ থেকে সরাতে বেকেনবাওয়ারের পরামর্শে রাইকার্ডের মুখে থুথু ছিটিয়ে বেরিয়ে আসা রুডি ফোলারের। ২০০৬ বিশ্বকাপ নিজেদের দেশে কীভাবে নিয়ে গিয়েছিলেন বেকেনবাওয়ার, ক্রমস উন্মোচিত হচ্ছে সত্য। তারপরও আবার বেকেনবাওয়াররা অভিযোগ জানান, রেফারির বিরুদ্ধে, হায়!

আর, ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির গোলরক্ষক যেভাবে সান্তি কাজোরলার ক্রসটা ফস্কেছিলেন, কলকাতা ময়দান তো তাঁকে বলে পাঁকাল মাছ ধরার চেষ্টা! জিরু হাত দিয়ে বল গোলে ঠেলে ঠিক করেননি। কিন্তু, ওভাবে ফস্কানো কি নয়ারের শোভা পায়?

Tuesday, October 20, 2015

মেসি-এনরিকে না-পেলে, প্রশ্ন উঠবেই

ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার পুরস্কারের ২৩ দাবিদার

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

কোনও সন্দেহ আছে কি, পুরস্কার কে পেতে পারেন নিয়ে?
ফিফা-র বালন দি’ওর ২০১৫ নিয়ে প্রচুর জল্পনা চলবে। বছরের শেষপর্ব যত এগিয়ে আসবে, গোলের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাবে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর। ইংরেজ-ঘেঁষা প্রচারমাধ্যম ও তাদের প্রতিনিধিরা প্রচুর লিখবেন, পোঁ ধরবে বাংলার বাজারি প্রচারমাধ্যমও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাবেন লিওনেল মেসি। আবার ত্রিমুকুট এনে দিয়েছেন। ইংরেজ ক্লাবগুলো শতবর্ষ পেরিয়ে পেরিয়ে আর ফুটবল খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে ক্লান্ত হতে হতে, একবার ত্রিমুকুট পেলে সারা জীবন ফাটা রেকর্ড শুনিয়ে যায়। মেসির ফুটবলার জীবনে এই নিয়ে দু-দু’বার হয়ে গেল ঘরোয়া লিগ, ঘরোয়া নকআউট ও মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন্ ট্রফি পাওয়া। তারপরও যদি প্রশ্ন ওঠে, মহা মুশকিল! বাজার বাজারের মতোই চলবে, স্বাভাবিক। মাছের বাজার হওয়ার চেষ্টা হবে। তাতে ত্রিমুকুট মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আর, মেসিদের খুব একটা যায়-আসে না তাতে, সে বাজার নিজেকে যতই হর্তা-কর্তা-বিধাতা ভাবুক না কেন!
সেরা ২৩ : লিওনেল মেসি, সের্খিও আগেরো, হাভিয়ের মাসচেরানো (আর্জেন্তিনা), টোনি ক্রুস, টমাস মুলার, ম্যানুয়েল নয়ার (জার্মানি), আলেক্সি সানচেজ, আর্তুরো ভিদাল (চিলে), এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডে ব্রুইন (বেলজিয়াম), করিম বেনজেমা, পল পোগবা (ফ্রান্স), ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল), হামেস রদরিগেজ (কলম্বিয়া), গ্যারেথ বেল (ওয়েলস), আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা (স্পেন), নেইমার (ব্রাজিল), লুইস সুয়ারেজ (উরুগুয়ে), জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ (সুইডেন), রবার্ট লেওয়ানডোস্কি (পোল্যান্ড), ইভান রাকিটিচ (ক্রোয়েশিয়া), আরিয়েন রবেন (নেদারল্যান্ড), ইয়াইয়া টুরে (আইভরি কোস্ট)
ঠিক যেমন সেরা কোচ কে হবেন তা নিয়েও খুব একটা সমস্যা নেই। বার্সেলোনাকে প্রথম বছরেই ত্রিমুকুট দেওয়ার পর লুইস এনরিকেই বছরের সেরা কোচ হওয়ার একমাত্র দাবিদার। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন কে? প্রাথমিক পর্যায়ে খানিকটা লড়াই হবে হোর্খে সাম্পাওলি-র সঙ্গে। চিলের কোচ, এবার চিলে-কে প্রথম কোপা আমেরিকা জেতাতে সাহায্য করেছেন, সেই কারণে। তবে, কোচদের সেরা দশে আর্সেন ওয়েঙ্গারের নাম কী কারণে, বোঝা দুষ্কর! ইংরেজ ক্লাবের কোচ হলে এমন বহু অযাচিত সুযোগ পাওয়া যায়। এফ এ কাপ, যা আমাদের দেশের ফেডারেশন কাপের সমতুল্য, আর কমিউনিটি শিল্ড যাকে আই এফ এ শিল্ড বলা যায়, সেই দুটি ট্রফি জেতার জন্য কি? নাগজি আর বরদলুই ট্রফি ফিরিয়ে এনে কোনও কোচ তা জিতলে কি ভারতেরই সেরা কোচ হবেন?
তাই, আগামী জানু্য়ারিতে এই দুই ট্রফি কাম্প নু-তে না-গেলেই উঠবে নানা আপত্তিকর প্রশ্ন!

ফিফার বর্ষসেরা কোচ হওয়ার দশ-দাবিদার

Wednesday, October 14, 2015

হায়দরাবাদে হাবিব এখন বড্ড অভিমানী, ব্যথিতও

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি ছিলেন ম্যাচের সেরা। জীবন গিয়েছে কেটে আটত্রিশ-আটত্রিশ বছরের পার। ২০১৫-র ১২ অক্টোবর তাঁকে আর মনে রাখার প্রয়োজন অনুভব করেননি কেউ!
মহম্মদ হাবিব একাই বসে আছেন হায়দরাবাদে। তাঁর সতীর্থরা, যাঁদের তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সেই দিন, মাঠে নিজেদের উজাড় করে দিতে, মঞ্চ আলো করে থাকলেন সে দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের পাশে দাঁড়ানোর হুড়োহুড়িতে। তিনি পড়ে থাকলেন দূরে। আয়োজকরা তাঁকে ডাকার প্রয়োজন মনে করেননি। আর সতীর্থরা হয়ত ভেবেই গেলেন, আয়োজকরা ঠিকই ডেকে আনবেন!
‘আমাকে জানাতে পারত। একবার টেলিফোন করলেও হত। জানতেই পারলাম না, কলকাতায় এসব হচ্ছে। আমিও তা হলে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম পেলের পাশে, আমার টিমের সবার সঙ্গে। কেউ জানালই না! মেরেকো ভুল গ্যয়ে সব’, বললেন ধরা গলায়।
অথচ, এমন সত্যিই নয় যে, সতীর্থরা ভুলে গিয়েছেন বড়ে মিঁয়া-কে। সুভাষ ভৌমিক তখনও গুয়াহাটি যাননি। পেলে-ম্যাচের স্মৃতিচারণে সবার আগে উঠে এলেন হাবিব। ‘মাঠের বাইরে আমাদের উজ্জীবিত করেছিল লড়তে। যেভাবে বলে বড়ে মিঁয়া, ওভাবেই বলেছিল, মাঠে নামার পর আমরা সবাই ফুটবলার। যতক্ষণ মাঠে থাকব, মনে রাখব সেটাই।’ গৌতম সরকার বলছিলেন, ‘কলজে ছিল, কলজে। ফুটবল মাঠে ওটাই জরুরি, বুকের ওই খাঁচাটা। তাতিয়ে দিয়েছিল আমাদের এমন যে, কী বলব।’ শ্যাম থাপার মতে, ‘গোলটা করেছিলাম আমি, বানিয়ে দিয়েছিল তো হাবিবই। তারপর নিজেও গোল করল, এগিয়ে দিয়েছিল। পেলের দলের বিরুদ্ধে আমরা এগিয়ে আছি ২-১, ভাবা যায়? হাবিব কিন্তু ভেবেছিল, করা যায়। তাই পেরেছিল।’
সত্যিই তো তা হলে ভুলে যাননি সতীর্থরা। কেন তা হলে ডাক পেলেন না হাবিব? অনুষ্ঠানের আয়োজক হাবিবের মোহনবাগান সতীর্থরা নন। দায়িত্ব নিয়েছিলেন আয়োজকরা। হায়দরাবাদের একা হাবিব নন, তাঁর ভাই আকবরও আসেননি ১২ অক্টোবর, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে। আমন্রণই পাননি। সাতাত্তরের পেলে-ম্যাচে খেলা ফুটবলারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি।
হাবিব জানতে চাইছিলেন, কী কী হল, কী কী হবে। ‘আমরা ভাগ্যবান। কারণ পেলে খেলেছিল তখন। এবার তো আর খেলবে না, তাই না? কী করে খেলবে, পঁচাত্তর হতে চলল। মাঠে খেলা আর ফাংশানে থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য’, বলছিলেন।
এমনকি, পেলের বিরুদ্ধে ম্যাচ অবিস্মরণীয় বলেও ওই ম্যাচটাকেই জীবনের সেরা বলতে রাজি নন। ‘কত ম্যাচ খেলেছি। ইন্ডিয়ার হয়ে, ক্লাবের হয়ে। গুরুত্বপূর্ণ, ট্রফি জেতার ম্যাচ। পেলে ছিলেন বিপক্ষে, নিউইয়র্ক কসমস অনেক বড় টিম, ঠিক। কিন্তু, টুর্নামেন্টের ম্যাচ ছিল না তো! ফ্রেন্ডলি। তবে পেলে তখন ফুটবলের রাজা। এখনও, কিন্তু অনেক দিন আগে খেলা ছেড়ে দিয়েছে। তখনও কিন্তু খেলছিল। কাজেই দুটো ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা।’
‘জান লাগা কে’ খেলেছিলেন তবু। যেমন খেলতেন বলে জনশ্রুতি, যে কোনও ম্যাচেই। কসমস সব জায়গায় জিততে জিততেই আসছিল। ইডেনে ছন্দপতন। রেফারি লক্ষ্মী ঘোষ পেনাল্টির ভুল সিদ্ধান্ত না-দিলে জিততেই পারত মোহনবাগান যা সেই সময় বিরাট কৃতিত্ব, নিঃসন্দেহে।
ঠিক যেমন খুবই ভাল হত, সুব্রত ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে যে-ফুটবলাররা রবিবার সন্ধেয় পেলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিহাসি মুখ করে গ্রুপ ফটো তুললেন সেই ছবিতে হাবিবও থাকলে।
‘কী হত খবর দিলে? আমিও একবার যেতাম, ছবি তুলতাম। ভালই লাগত। কিন্তু ওই যে বললাম, সবাই তো ভুলেই গেছে। কেনই বা ডাকবে আমাকে’, বড়ে মিঁয়ার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে, লুকনো যায় না টেলিফোনেও।
সত্যিই তো, কলকাতা থেকে হায়দরাবাদ কি সাও পাওলো থেকে কলকাতার দূরত্বের চেয়েও বেশি? যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ম্যাচে নিজেদের মেলে ধরতে কোনও অসুবিধে হয়নি সতীর্থদের তাঁকে একবার ডাকা গেল না নিজেদের উদ্যোগেও? আয়োজকরা ভুলে গেছেন, যেতেই পারেন। মনে করিয়ে দেওয়াটাও কি উচিত ছিল না সতীর্থদের, বিশেষত অধিনায়কের?

হয়ত করেছিলেন, হয়ত করেননি। হায়দরাবাদে হাবিব কিন্তু বড্ড অভিমানী এখন, ব্যথিতও।

Monday, October 12, 2015

২ পেলে-বিতর্ক!

কাশীনাথ ভট্টাচার্য
বাউরুর লিগে ছোট পেলের প্রথম পরিচয়পত্র

পেলের জন্ম কবে?
সবাই তো জানেন, ২৩ অক্টোবর। সবজান্তা উইকিপিডিয়াও তো তাই-ই বলছে। তা হলে হঠাৎ প্রশ্ন কেন?
আসলে, প্রশ্নের উৎস সানতোস (Santos) ক্লাবের জাদুঘরে দেখা একটি ছবি। পেলে সই করেছিলেন সানতোস-এ, বাউরুর লিগে নথিভুক্ত হ্ওয়ায় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর । সেখানে জুনিয়র ফুটবলার হিসেবে নথিভুক্ত পেলের জন্মতারিখ জ্বলজ্বল করছে – ২১ অক্টোবর, ১৯৪০।
পেলের প্রথম পাসপোর্ট
অতঃপর, সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিলাম হাতের কাছেই। পেলের আত্মজীবনী ‘Pele, The Autobiography’-র ১৪ পাতায় (Simon & Schuster UK Ltd, 2006 Edition)। পেলে যেখানে দুই সহলেখক ওরলানদো দুয়ার্তে ও আলেক্স বেয়োস-কে জানিয়েছিলেন, ‘গণ্ডগোল তো আমার বার্থ সার্টিফিকেটেই। লেখা আছে ২১ অক্টোবর। কী করে হয়েছিল, জানা নেই। হয়ত ব্রাজিলে আমরা নিখুঁত হতে ততটা আগ্রহী নই বলেই। ব্যাপারটা ওখানেই শেষ নয়। আমার পাসপোর্টে এখনও ওই ২১ অক্টোবরই লেখা আছে। কতবার তারপর পাসপোর্ট পাল্টালাম। প্রতিবারই বলি, জন্মতারিখটা ঠিক করে দিতে। এখনও পাল্টানো যায়নি!’
স্মৃতিধর নই। কিছুই মনে থাকে না প্রায়। যখন পড়েছিলাম, অদ্ভুত লেগেছিল। মনে রাখাও উচিত ছিল। কিন্তু, থাকেনি। পরে সানতোসের জাদুঘরে জন্মতারিখটা দেখে খটকা লাগায় আর একবার বইয়ের পাতা উল্টে স্বস্তি।
দ্বিতীয় খটকার সমাধানও ছিল ওই একই পাতায়। অনেক জায়গায় এখনও এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো-কে ‘এদিসন’ ডাকা হয়। পেলে বারবারই বলেন, তিনি ‘এদিসন’ নন, ‘এদসন’। ত্রোস কোরাকোস, পেলের জন্ম যেখানে, সেই গ্রামে পেলে পৌঁছনর কিছু দিন আগেই এসেছিল বিদ্যুৎ। আমরা সবাই জানি টমাস আলভা এডিসনের কথা। গ্রামে বিদ্যুৎ এসে যাওয়ায় এতটাই খুশি হয়েছিলেন পেলের বাবা হোয়াও রামোস দো নাসিমেন্তো ওরফে দোনদিনিও যে, ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘এদসন’। বাড়তি ‘আই’-এর উপস্থিতি ছিল না নামে, পেলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ওই একই পাতায়। কিন্তু, পেলের বিরক্তি এখনও যায়নি। বহু সরকারি নথিতে এখনও ‘আই’ উপস্থিত। ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারের নিজের কথায়, ‘সরকারি বা ব্যক্তিগত নথিতে এখনও কী করছে ওই বাড়তি ‘আই’-টা, আর ভাল লাগে না লোককে বলতে।’

আমাদের ভারতে যেমন, ব্রাজিলেও বোধহয় সরকারি নথিতে নাম-জন্মতারিখ পাল্টানো প্রচুর ঝামেলা। না হলে, নাম আর জন্মতারিখ নিয়ে এমন সমস্যা থেকেই যায়, তা-ও আবার পেলের, গত প্রায়-পঁচাত্তর বছরে!
 আত্মজীবনীর সেই পাতা

Sunday, October 11, 2015

ঈশ্বরের সই কি নেওয়া যায়, সম্ভব?

কাশীনাথ ভট্টাচার্য



ভোররাতেই বিপত্তি!
ব্রাজিলে প্রথম রাত। সাও পাওলোর হোটেলের ঘরে একা। বাইশ ঘন্টার বিমানযাত্রার পর ঘন্টা দুই গাড়িতে। কোনও রকমে ঘরে ঢুকে স্নান সেরে কিছু খেয়েই ঘুম। মনেই ছিল না মোবাইল-ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার কথা। পরদিন সকাল-সকাল উঠেই যেতে হবে আরেনা কোরিন্থিয়ান্সে, বিশ্বকাপ ‘কভার’ করার জন্য ‘অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড’ তুলতে। মাথায় ওই চিন্তা নিয়েই বিছানায়। আর, ঘুম যখন ভাঙল? মোবাইল-ঘড়ি দেখাল সাড়ে এগারটা!
জেট-ল্যাগ কাটানো ঘুম বলে কথা! কিন্তু, সময় দেখে চোখ কপাল ছাড়িয়ে টাকে! কখন মাঠে যাব, কখন কার্ড তুলব? স্নান-টান সেরে নিলাম চটপট। পাটভাঙা ধুতি হয়, জামা কি বলা যায় ইস্তিরিভাঙা? কে জানে, ভাবার সময়ও নেই। চটপট দেখে নিলাম ফিফার পাঠানো ইমেল-এর প্রিন্ট আর পাসপোর্ট ব্যাগে আছে কিনা। ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে বেরিয়ে পড়া, ঘর লক করে।
সাততলা থেকে রিসেপশনে নেমে কফি মেশিন দেখে থমকে যাওয়া। ঘুম থেকে উঠে যে কিছুই খাইনি, মনে পড়ল যেন। পাশে ব্রেকফাস্ট-এর ঘর। কিন্তু, বড়-বড় করে লেখার সারকথা, ‘সাড়ে দশটার পর খাবার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’। পর্তুগিজ ভাষায় পণ্ডিত নই। যা লেখা ছিল ইংরেজির ওই ‘টেন’ আর ‘থার্টি’ পড়েই বুঝে নেওয়া। আমার সময় তখন বারটা দশ। ‘খামোখা ভেবে লাভ নেই, চটপট কফিটা খেয়ে ট্যাক্সিতে ওঠ রে, ব্রাজিলে প্রথম সকালটাই মাখিয়ে ফেললি’ মনে মনে নিজেকে অশ্রাব্য কিছু শব্দ বলে কফির জন্য দাঁড়ালাম। ‘চিনি-ছাড়া’ বোঝাতে প্রাণান্ত। নাটক শিখিনি, হাত নেড়ে বোঝানোও সমস্যা। কোনও রকমে বুঝল মিষ্টি মেয়ে। নজর সরাইনি। ঠিক যা ভেবেছিলাম! শেষে চিনির দুটো পাউচ এগোতেই ‘না না’ বলে ফেরত। তৃপ্তির চুমুক ব্রাজিলের বহুকালের শোনা বিখ্যাত কফিতে। দৃষ্টি অবশেষে সামনে এবং আবারও চোখে অবিশ্বাস! বাইরেটা এত কালো কেন?
বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চশমা, ছিপছিপে লম্বা, ইংরেজি-জানা এরিক গত রাত থেকে তখনও কাজে। কী ব্যাপার বলুন তো, এত অন্ধকার কেন বাইরে, জিগ্যেস করেই ফেললাম, কফিতে আরও দুটো চুমুক মেরে। ঠোঁট চওড়া হল, ‘রাত তিনটে পঁয়তাল্লিশ বাজে, অন্ধকার তো থাকবেই। আপনাদের ইন্ডিয়ায় কি’ কথা শেষ করতে দিই না এরিককে। মোবাইল বলছে সোয়া বারোটা। মাথা খুলল তখন। সাও পাওলো বিমানবন্দরে নেমে ভেবেছিলাম, ঘড়ির সময়টা বদলে নেব, ভারত থেকে ব্রাজিলে। ভুলে গিয়েছি। সাড়ে আট ঘন্টা এগিয়ে চলছি আমি, ভারতীয় সময়ানুসারে!
অগত্যা কফি শেষ করে, কনকনে ঠাণ্ডায় হোটেলের মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট শেষ করে আবার পাততাড়ি গুটিয়ে সাততলার ঘরে। ইস্তিরিভাঙা জামা-প্যান্ট ছেড়ে কম্বলের তলায়। ঘড়িকে ব্রাজিলের সময়ে পরিবর্তিত করে, সকাল আটটায় অ্যালার্ম দিয়ে, আবারও ঘুমের দেশে।
গৌরচন্দ্রিকা এত বড় হলে রাগ করতেই পারেন, অধিকার আছে চটে যাওয়ার। কিন্তু, নিরুপায়। দিনের শুরুতেই ‘এমন’ বিপত্তি বললে সেই ‘এমন’টা যে ঠিক ‘কেমন’ বুঝিয়ে বলার দায় থাকে। তাই, (পেলের) ধান ভানতে শিবের (থুড়ি, সময় পরিবর্তনে বিপত্তির) গীত!
দিনের শেষে অবশ্য এই শর্মাই গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে মুণ্ডপাত করছিল ইংরেজি প্রবাদের। কোন হালায় কইসে রে, (বঙ্গানুবাদে) দিনের শুরুটা কেমন হল দেখে সারা দিনটা কেমন যাবে আন্দাজ করা যায়? গলায় ফিফা বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, পকেটে পেলের প্রেস কনফারেন্স, সঙ্গে আবার ক্যামেরায় পেলের ছবিও! ওভাবে দিন শুরু করে সেই দিনের শেষেই এগুলো সম্ভব?
প্রবাদকেও প্রমাদ বানিয়ে দেওয়া সেই সৃষ্টিছাড়া দিনে আসলে দ্বিতীয়বার ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই সব পায়ে-বলে ঠিকঠাক। ভাষা বিভ্রাট সম্পর্কে সম্যক ধারণা আগের রাতেই হয়ে যাওয়ায় ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় ফিরে এসেছিলাম সেই সকাল থেকেই। তাতেই বোধহয় সিদ্ধিলাভ! একা একাই ট্যাক্সি চড়ে আরেনা কোরিন্থিয়ান্স-এ। কার্ড তোলা, পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা, গল্প। কলকাতার কয়েকজন আরও আগে গিয়েছিলেন। যা হয় বিদেশে তারপর। গপ্পোগাছা, কী কী ‘কপি’ পাঠানো হল, চর্চা। আমি তখনও খাতা খুলিনি। তাই কিছু বলার নেই, শুধুই শোনা। লুকোনরও কিছুই নেই যে!
একই অবস্থা ছিল ধীমানেরও। ধীমান সরকার, হিন্দুস্তান টাইমস-এর মস্ত ফুটবল-লিখিয়ে। ব্রাজিল ওর তৃতীয় বিশ্বকাপ। কলকাতা থেকে একসঙ্গেই গিয়েছিলাম, একই ফ্লাইটে। বিয়াল্লিশ দিন পর ফিরবও একসঙ্গেই। কার্ড তুলে গপ্পো করছি, ধীমানই জানতে চাইল, সন্ধেবেলা কী করব। মনে হল, গল্প একটা আছে বোধহয়। ধীমানের বন্ধু আবার ফিফায় ভলেন্টিয়ার। ঘোড়ার মুখের খবর, জারদিম পাউলিস্তা যেতে হবে। পাঁচতারা হোটেল স্কাই। ফুটবল পত্রিকার উদ্বোধন। কাফু থাকছেন। সাও পাওলো তো কাফুরই শহর। আর ছিল সেই ব্রাজিল যাত্রার যা অন্যতম কারণ, পেলে নাকি আসতে পারেন!
সাংবাদিক হিসেবে লুকোচুরির কিছু নিয়ম আছে। চুপি চুপি নয়, বেরিয়ে গেলাম সবাইকে টা-টা করেই। সন্ধে সাতটায় শুরু। সাও পাওলোর মেট্রো চেপে খানিক দূর। তারপর ট্যাক্সি এবং গন্তব্যে পৌঁছন নির্ধারিত সময়ের মিনিট পনের আগে। গলায় ঝোলানো ফিফার কার্ড। বেশ মেজাজেই ঢুকে পড়লাম অনাহূত। সোজা লিফটে এবং রুফটপ। এলাহি কাণ্ড। গান বাজছে, স্টেজ তৈরি। পানপাত্রে চলকে যায় সন্ধে। ব্রাজিলের সুগন্ধিত-সুন্দরীদের প্রথম দেখা, অত সামনে থেকে। সাংবাদিক, ক্যামেরাওম্যান-রাও এমন ডাকসাইটে সুন্দরী!
হঠাৎ গুঞ্জন। কাফু ঢুকলেন। তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল, পরপর। ঘরে দুটো বিশ্বকাপ জয়ের ট্রফি। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, যদি সুযোগ পাই ভিড়টা কাটলে। পাওয়া গেল আধঘন্টা পর। সবাই গিয়ে ‘সেলফি’ নিচ্ছে, আমরা ছবিই তুললাম। কথা বলতে যেতেই, ‘নো ইংলেস’, ‘নো ইংলেস’। অতঃপর, দুপাশে দু্ই বঙ্গসন্তান, মাঝে কাফু, থাকলাম খানিকক্ষণ। অনেকক্ষণ বললেই ঠিক। নির্ধারিত সময় পার। কাউকে জিগ্যেস করে যে জানব, তিনি আসবেন কখন, উপায় নেই। প্রায় সবাই ‘নো ইংলেস’ দলে। ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল। কলকাতার মতো কোনও কোনও খুব পরিচিত সাংবাদিক তো বার তিনেক নিয়ে ফেললেন কাফুর বাইট! একবর্ণও বুঝিনি তো কী, আমরা মাঠ ছেড়ে, মানে কাফুকে ছেড়ে, পালাইনি!
আবার একটা হইচই এবং কাফু হঠাৎ একা। কলকাতা থাকাকালীনই বহু বিজ্ঞ বাঙালির মুখে শুনেছিলাম, পেলেকে নাকি ব্রাজিলে কেউ দেখতেই পারে না! চোখের সামনে দেখলাম, কাফু স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়ি্য়ে দেখলেন, ৭৪-বছর বয়সী কেউ কীভাবে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত করছেন, তখনও। আমরাও দৌড়লাম, বাধ্য। নীল স্যুট, সাদা জামা, হলদে-কালো টাই, কুচকুচে কালো চুলের চিরসবুজ সম্রাট ততক্ষণে আসরে!
ক্যামেরার ভিড় ঠেলে গুটি গুটি পায়ে একেবারে সামনে। নিজের হাতেও ক্যামেরা। পরপর ছবি তুলছি, পাগলের মতোই। দেড়হাত দূরে ঈশ্বর! ফুটবল শব্দটাই তো জানা তাঁর সৌজন্যে। খেলতে দেখিনি, প্রশ্নই ছিল না। কলকাতায় সাতাত্তরে যখন এসেছিলেন, বয়স সাড়ে সাত। শুধু বাঁশি শুনেছি-র মতো, কিংবা বিজ্ঞাপন, সির্ফ নাম হি কাফি হ্যায়। ওই নামেই ফুটবল, ওই নামেই ব্রাজিল, ওই নামেই আকর্ষণ। কোথায় ইউটিউব তখন! বয়সে বেড়ে বইতে পড়া, ছবি দেখা। অমোঘ টান!

যা লিখেছিলাম সেই দিন, মিড-ডে কাগজে
পর্তুগিজ পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হল। তারপর, নানা প্রশ্ন। কাফুর মতো ‘নো ইংলেস’ বলেননি, গোটা তিনেক প্রশ্ন ইরেজিতেই, উত্তরও এল ইংরেজিতে। বাকিগুলো একবর্ণও বুঝিনি। শেষ হতেই ল্যাপটপের দিকে নজর ঘুরে-ঘুরে। ইংরেজিতে লিখছেন নাকি কেউ, তীক্ষ্ণ নজরদারি। ‘এদিকে আয়, পেয়েছি’ ধীমানের স্বর তখন লতা মঙ্গেশকারের চেয়েও মধুর!

মিড-ডে, সেই স্টোরি-র লিংক - http://www.mid-day.com/articles/brazil-has-no-obligation-to-win-the-world-cup-pele/15366192

তিনি চলে যাওয়ার পরই অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত। যতক্ষণ ছিলেন, কাফুর দিকেও কেউ ফিরে তাকাননি। ব্রাজিল যে পাঁচবার বিশ্বজয়ী, ওই দুজনের ঘরে সেই পাঁচটা ট্রফির প্রতিরূপ আছে! এমনকি, টানা তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার কৃতিত্ব পেলেরও নেই। তবু, কাফু যেন তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি ছবির পার্শ্বনায়ক। পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সঙ্কুচিত। গলা উঠছে না। ভাবখানা, ‘উনি থাকতে আমাকে কেন’!
তখন কি আর জানতাম যে, বিশ্বকাপে পরের ৪১ দিনে আর কখনও দেখা পাব না তাঁর? আসবেনই না আর বিশ্বকাপের ধারেকাছে? সাহস করে প্রথম রাতেই সই চেয়ে নিতাম তা হলে, নির্লজ্জ। হাতের এত কাছে, এই কলকাতাতেই তো পাব না তাঁকে, কখনও।

কিন্তু, পরে মনে পড়েছিল, ঈশ্বরের কি সই হয়, নেওয়া যায়?

Thursday, October 8, 2015

নেই মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ, সানচেজ-ভিদাল অনিশ্চিত, তারকাহীন শুরু

চোট পাওয়ায় মেসি খেলতে পারছেন না বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের শুরুর চার ম্যাচে

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

লক্ষ্য এবার রাশিয়া ২০১৮।
কিন্তু, শুরুতেই সমস্যা। সেরা তারকরাই যে নেই!
আর্জেন্তিনা পাচ্ছে না লিওনেল মেসিকে, ব্রাজিলের হয়ে খেলতে পারবেন না নেইমার, কলম্বিয়ায় নেই হামেস রদরিগেজ, উরুগুয়ের জার্সিতে দেখা যাবে না লুইস সুয়ারেজ ও এদিনসন কাভানিকে। কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন চিলেও হয়ত পাবে না আলেক্সি সানচেজ ও আর্তুরো ভিদালকে। শুরুতেই ছন্দপতন!

কনমেবোল থেকে বিশ্বকাপে
দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দশ দেশ খেলে প্রাক-বিশ্বকাপে। রাউন্ড রবিন লিগ। প্রতিটি দেশ খেলবে প্রত্যেক দেশের বিরুদ্ধে। বছর দুই পর প্রতিটি দেশের ১৮টি করে ম্যাচ শেষে তালিকায় প্রথম চার দেশ সরাসরি যাবে রাশিয়ায়। পঞ্চম স্থানে থাকা দেশ খেলবে প্লে অফ, ওশিয়ানিয়ার সেরা দেশের বিরুদ্ধে। জিতলে যাবে মূলপর্বে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পঞ্চম দল হিসেবে।
কোপায় কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে মারামারি করে বাছাইপর্বের প্রথম দুটি ম্যাচে বাইরে নেইমার

প্রথম রাতে
সেরা ম্যাচ নিঃসন্দেহে চিলে বনাম ব্রাজিল। ২০১৪ বিশ্বকাপে এই ম্যাচ নিয়ে প্রচুর আলোচনা ছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ। বেলো ওরিজোন্তে-তে। যে-মাঠে পরে সেমিফাইনালে নেইমারহীন ব্রাজিল হারবে ১-৭, জার্মানির কাছে। কিন্তু, এস্তাদিও মিনেইরাও-তে সেই দিন নায়ক হয়ে উঠেছিলেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক হুলিও সিজার। দাভিদ লুইজের গোল শোধ করেছিলেন আলেক্সি সানচেজ। পরে টাইব্রেকার। এবং ব্রাজিল জেতে ৩-২। পিনিয়া আর সানচেজের শট আটকে প্রথম দুটি শটে চিলে-কে গোল করতে না দিয়ে নায়ক সিজার।
এবার সানচেজ সম্ভবত নেই। আর্সেনালের হয়ে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে খেলার দিনই চোট পেয়েছিলেন। এই ম্যাচের জন্য সানচেজকে ছাড়তেই চাননি আর্সেন ওয়েঙ্গার। কিন্তু, নিয়মে বাঁধা। ছেড়েছন, আশঙ্কা নিয়ে। ‘জানি না, কী অবস্থায় ফিরবে। কিন্তু, বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ ছাড়তে চাইবে না আলেক্সি, স্বাভাবিক।’ ভিদালকে তো পেপ গারদিওলা খেলাতেই পারছেন না বায়ার্নে, চোটের কারণে।
নির্বাসন এখনও কাটেনি সুয়ারেজের

বলিভিয়ায় খেলতে যাচ্ছে উরুগুয়ে। লা পাজে উরুগুয়ে এখনও জিততে পারেনি। তার ওপর সুয়ারেজ আর কাভানি নেই মানে গোল করার লোকই নেই।
বরঞ্চ ঘরের মাঠে নায়ক হয়ে উঠতে পারেন সের্খিও আগেরো, ইকুয়েদরের বিরুদ্ধে। অধিনায়ক লিওনেল মেসি নেই। বিরাট সুযোগ বুয়েনস আইরেসে তাই আগেরোর সামনে। দুরন্ত ছন্দে আছেন ইপিএল-এ। এক ম্যাচে পাঁচ গোলও করে ফেলেছেন। কার্লোস তেভএজ ততটা ছন্দে নেই আর্জেন্তিনায় ফিরে। কিন্তু গোনজালো ইগুয়াইনও খারাপ খেলছেন না নাপোলিতে। সমস্যা হল, নাপোলির ছন্দ ইগুয়াইন কিছুতেই ফিরে পান না আকাশি-সাদা জার্সিতে। তবে, ইকুয়েদরকে ঘরের মাঠে হারানোর জন্য আগেরো-ইগুয়াইন জুটিই যথেষ্ট হওয়া উচিত। না হলে নিশ্চিতভাবেই সমস্যা বাড়বে কোচ তাতা মার্তিনোর।
ভারতের দর্শক সোনি কিক্স ম্যাচ সরাসরি দেখতে পাবেন, যার মধ্যে চিলে-ব্রাজিল দেখার জন্য ভোর পাঁচটায় নিশ্চিতভাবেই অ্যালার্ম দিয়ে রাখবেন অনেকে!

আজ রাতে

কলম্বিয়া-পেরু (রাত ১-৩০)
বলিভিয়া-উরুগুয়ে (রাত ১-৩০)
ভেনেজুয়েলা-পারাগুয়ে (রাত ২-৩০, সরাসরি সোনি কিক্স)
চিলে-ব্রাজিল (ভোর ৫-০০, সরাসরি সোনি কিক্স)
আর্জেন্তিনা-ইকুয়েদর (ভোর ৫-৩০)

·         ভারতীয় সময়ানুসারে

বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির পারফরম্যান্স, একঝলকে

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

বিশ্বকাপে কোন দেশ কতগুলি করে ম্যাচ খেলেছে, অনেকেই জানেন। কিন্তু, বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের হিসেব?
এখানে তুলে ধরা হল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির পারফরম্যান্সের ছোট তালিকা। এই হিসেব ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব শেষে। ভারতীয় সময় ৮ অক্টোবর রাত পোহালেই খেলা শুরু। তার আগে চোখ বুলিয়ে নেওয়া, দশ-দেশের পারফরম্যান্সে, একঝলকে।

দেশ
ম্যাচ
জয়
ড্র
হার
স্বপক্ষে গোল
বিপক্ষে গোল
পয়েন্ট
উরুগুয়ে
১৩৬
৬০
৩৮
৩৮
১৮৬
১৪৪
২১৮
পারাগুয়ে
১৩৬
৫৯
২৭
৫০
১৮২
১৬৪
২০৪
কলম্বিয়া
১৩৪
৫০
৪০
৪৪
১৫৯
১৪০
১৯০
বলিভিয়া
১৩২
৩৫
২৭
৭০
১৬১
২৪৬
১৩২
পেরু
১২৯
৩৫
৩১
৬৩
১৩৫
১৮৫
১৩৬
চিলে
১২৮
৫৩
২৭
৪৮
১৯১
১৬৮‌
১৮৬
ইকুয়েদর
১২৫
৪১
৩১
৫৩
১৪৩
১৭৩
১৫৪
ভেনেজুয়েলা
১২২
২৩
১৯
৮০
১০১
২৭৯
৮৮
আর্জেন্তিনা
১১৮
৬৮
২৯
২১
২১৬
১১১
২৩৩
ব্রাজিল
৯২
৫৬
২৫
১১
১৯৯
৫৯
১৯৩

সবচেয়ে বেশি ম্যাচ – উরুগুয়ে, পারাগুয়ে (১৩৬)

সবচেয়ে কম ম্যাচ – ব্রাজিল (৯২)
সবচেয়ে বেশি জয় – আর্জেন্তিনা (৬৮)
সবচেয়ে বেশি হার – ভেনেজুয়েলা (৮০)
সবচেয়ে বেশি গোল দিয়েছে – আর্জেন্তিনা (২১৬)
সবচেয়ে বেশি গোল খেয়েছে – ভেনেজুয়েলা (২৭৯)
জয়ের শতাংশ সবচেয়ে বেশি – ব্রাজিল (৬০.৮৬)

ম্যাচ-প্রতি গোল দিয়েছে সবচেয়ে বেশি – ব্রাজিল (২.১৬)