Thursday, June 26, 2025

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / নীল চোখ, নীল জার্সির ‘রোজোনেরি’-কে জন্মদিনে পাতা উল্টে দেখা, ভালবাসায় …

 


** আজ ২৬ জুন তিনি ৫৭

সুভাষ ভৌমিক বলতেন, ভারতীয় ফুটবলে রাইট ব্যাকের জায়গায় সুধীর কর্মকারের মূর্তি বসানো উচিত। বিশ্ব ফুটবলে লেফট ব্যাকের জায়গায় ঠিক তেমনভাবেই থাকা উচিত যাঁর মূর্তি তাঁর নাম পাওলো মালদিনি!

ফুটবল ইতিহাসে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জিয়াসিনতো ফাচেত্তি। কাতেনাচ্চিওর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যিনি ছিলেন মালদিনির চিরশত্রু শিবির ইন্তার মিলানে, আর্জেন্তিনীয় কোচ এলেনিও এরেরার অন্যতম সেরা অস্ত্র হিসাবে, নীল-কালো জার্সিতে। ট্রফির হিসাবে ফাচেত্তি এগিয়ে ১৯৬৮- ইউরো জয়ের কারণে। বিশ্বকাপ ফাইনালে দুজনেই হেরেছিলেন ব্রাজিলের কাছে সত্তরের মেহিকোয় পেলের ব্রাজিল উড়িয়ে দিয়েছিল ফাচেত্তির ইতালিকে -, মালদিনির ইতালিকে হারাতে অবশ্য বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথম টাইব্রেকারের সাহায্য নিতে হয়েছিল রোমারিও-বেবেতোর ব্রাজিলকে, ১৯৯৪ সালে।

দুই মিলানের শত্রুতা এমন, মিলান শহরে যে স্টেডিয়াম তাদের ঘরবাড়ি, নামটাও পাল্টে ডাকেন দুদলের সমর্থকরা এসি মিলান, আসলে যাদের মালিকানা ছিল, বলেন সান সিরো; ইন্তার, পরে যারা ভাড়াটে হিসাবে এসেছিল শুরুতে, বুক ফুলিয়ে ডাকে জিউসেপ্পে মিয়াজা। তবুও, এই ইতিহাসে বিরোধিতা যতটা, খুব কমই থাকে ফাচেত্তি-মালদিনি প্রশ্নে।

কারণটা বলে গিয়েছিলেন ফাচেত্তি, তাঁর অমর মন্তব্যে। ইতালীয় ফুটবলে আমার জায়গায় কে? মালদিনিকে দেখার পর এই প্রশ্নটাই অর্থহীন। পাওলোর একটাই সমস্যা, চিরকাল খেলল এসি মিলানের হয়ে!

রোবের্তো কার্লোস এসেছিলেন। ফ্রি কিক থেকে গোলগুলোর জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ কখনও কখনও তাঁর নামও এনেছেন আলোচনায়। কিন্তু, লেফট ব্যাকের প্রাথমিক কাজ রক্ষণ মাথায় রাখলে কার্লোস কোথায়? তিনি যে তখন নিজের রক্ষণে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন জিনেদিন জিদানের পাস কী করে থিয়েরি অঁরি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে গোল করে যাচ্ছেন!

ইতালির রক্ষণভাগের ফুটবলারদের সম্পর্কে একেবারেই অযৌক্তিক কিছু ধারণা সুপ্রচলিত বাংলায়। বাজারি সংবাদমাধ্যমের কারণে তা পল্লবিতও হয়ে উঠেছে গত বছর চল্লিশে। যাঁরা এমন ধ্যানধারণার কল্পজগতে বসবাস করেন তাঁরা জেনে কী বলবেন যদিও জানা নেই, তবু, লেখা উচিত ফাচেত্তি ১৮ বছরের ফুটবল-জীবনে লাল কার্ড দেখেছিলেন একবার; কুড়ি বছরে দুবার দেখেছিলেন ফ্রাঙ্কো বারেসি; ২৫ বছরে তিনবার সেই দুর্ভাগ্য হয়েছিল মালদিনির। এর চেয়ে পরিষ্কার করে আর কোনওভাবেই বোঝানো যায় না মারি অরি পারি যে কৌশলে অস্ত্রে আর যা- থাকুক মার ছিল না মালদিনিদের তূণে, কখনও।

পড়ে আবার চমকে উঠবেন না, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেফট ব্যাকের জীবন শুরু হয়েছিল এসি মিলানে, রাইট ব্যাক হিসাবে!

এখানে কারণ মাওরো তাসোত্তি। মধ্যগগনে তখন, কী করে নবাগত কাউকে তাসোত্তির জায়গায় খেলানো সম্ভব? মিলানের দায়িত্বে তখন নিলস লিয়েডহোম। পরামর্শ দিয়েছিলেন ষোলর মালদিনিকে ডানদিকে শুরুটা তো কর, দেখছি তারপর আটের দশকের মাঝামাঝি সেই সময় মালদিনি তখন ডানপায়ের ফুটবলার। ক্রমশ বুঝতে পারেন, রক্ষণে নিজেকে আরও উন্নত করতে বাঁপায়েও সমান কুশলী হয়ে উঠতে হবে। শুরু সেই সাধনা, যার শেষ শ্রেষ্ঠ আসনে বসে। এমন উত্তরণও কি আর দেখেছে ফুটবল ইতিহাস?

মালদিনি আসলে শুরু থেকেই বিচরণ করেছেন সর্বোচ্চ স্তরে, সুপারলেটিভ বারেসি, কোস্তাকুর্তাদের পাশে নিজেকে চিনিয়েছেন। পরের কানাভারো-নেস্তারা উঠে এসেছেন তাঁকে সামনে রেখে। মারাদোনা, জিদান, রোনালদোর বিরুদ্ধে খেলেছেন অকুতোভয়। এমনকি, ক্রিস্তিয়ানোর বিরুদ্ধেও। শুধু, খেলা হয়নি মেসির বিপক্ষে। প্রশ্নকর্তা শুনে বলে ফেলেছিলেন মেসির সৌভাগ্য সঙ্গে সঙ্গেই কারেকশন করে দিয়েছিলেন মালদিনি, না, আমার সৌভাগ্য!

ইল কাপিতানো মালদিনি এবং তাঁর ইতালি সম্পর্কে ভাবতে গেলেই মনে পড়ে যায় স্টেফান এডবার্গকে, আর মাইকেল স্টিচের বিরুদ্ধে উইম্বলডনে সেই ম্যাচটা। সেই ১৯৯১ সেমিফাইনালে এডবার্গ হেরেছিলেন , , , ৭। সার্ভিসব্রেক একবারই হয়েছিল। স্টিচের সার্ভিস ভেঙেছিলেন আগের বারের চ্যাম্পিয়ন এডবার্গ। সুইডিশ এডবার্গের সার্ভিস অবশ্য একবারও ব্রেক হয়নি তেইশটি গেমে। উইম্বলডনে পুরুষদের সিঙ্গলস সেমিফাইনালে একবারও সার্ভিস গেম নাহারিয়ে ম্যাচ হেরে যাওয়ার একমাত্র দৃষ্টান্ত।

মালদিনির ইতালি দেখুন। ১৯৯০ বিশ্বকাপ নিজেদের দেশে। সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনার সের্জিও গোয়কোয়চিয়ার হাতে আটকে বিদায়। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হার ব্রাজিলের কাছে, যেখানে রোবের্তো বাজ্জিওর শেষ পেনাল্টিমিস এখন বিশ্বকাপের বিষাদগাথায়। ২০০২ বিশ্বকাপের প্রথম ১৬য় অন্যতম আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হার সোনালি গোলে। ঠিক যেমন ২০০০ ইউরো ফাইনালে ফ্রান্সের দাভিদ ত্রেজেগুয়ের সোনালি গোল, আবার।

টাইব্রেকারে যে দুটি ম্যাচে হার, ফিফার রেকর্ড বলছে, ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর ১৯৯৪ ফাইনালের ফল ড্র। কারণ, টাই ভেঙে ম্যাচের ফয়সালা হলেও ফিফার খাতায় সেই ম্যাচ অমীমাংসিতই থেকে যায়। কিন্তু, দেশের হয়ে বিশ্বকাপ তো দূরের কথা, কোনও ট্রফিই ওঠেনি মালদিনির হাতে!

এডবার্গের বিস্ময় যেমন, একবারও সার্ভিস নাখুইয়ে হেরে গেলাম, প্রথম দুটি বিশ্বকাপের পর মালদিনির বিস্ময়ও একইরকম, হারিনি, সাতটা করেই ম্যাচ খেলেছি, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন নই!

এমনকি, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে শুরুর মিনিটে গোল পেয়েও নির্ধারিত সময়ের খেলাশেষে - ছিল ম্যাচ, পরে টাই ভেঙে স্টিভেন জেরার্ডরা ট্রফি নিয়ে গিয়েছিলেন কামাল আতাতুর্ক স্টেডিয়াম থেকে। কিন্তু, টাইব্রেকারের কারণেই সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফল, এখনও বলছে, অমীমাংসিত!


আক্ষেপ
নেই রোজোনেরি মালদিনির তবুও। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে তিনি একক্লাবের ফুটবলার জীবনে এসি মিলান ছাড়া আর কোনও ক্লাবের হয়ে খেলেননি। বাংলার একক্লাবের ফুটবলারদের সঙ্গে মেলাতে চাইলে গুলিয়ে যাবে। কলকাতায় জীবনের শুরু থেকে শেষ একই ক্লাবে অসম্ভব, কারণ, বড় ক্লাবের ছোটদের দল থাকে না এখানে। আজীবন মোহনবাগান যাঁরা, সিনিয়র স্তরে পৌঁছনো এবং মোহনবাগানে সইয়ের পর, আর কখনও সবুজমেরুন তাঁবুর বাইরে বেরননি। যেমন কলকাতা মাঠে সুব্রত ভট্টাচার্যের শুরু বালি প্রতিভায়, পরে বিএনআর হয়ে মোহনবাগান এবং শেষ করেছিলেন সবুজমেরুন জার্সিতেই। মালদিনির ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ লালকালো, কোনও বালি প্রতিভা নেই তাঁর জীবনে। ১৯৬৮ সালে জন্মে ১৯৭৮এর শুরুর আগে পর্যন্ত ফুটবল খেলেছিলেন শুধুই রাস্তায়। এসি মিলান ইউথ অ্যাকাডেমিতে সেই যে ১৯৭৮ সালে নাম লিখিয়েছিলেন, ৩১ মে ২০০৯, ফিওরেন্তিনার বিরুদ্ধে জিতে ফুটবলার জীবনকে আলবিদা জানানোর সময় পর্যন্ত, তিনি শুধুই এসি মিলানের।

কোচ হবেন না, জানিয়ে দিয়েছিলেন অবসর নেওয়ার সময়। প্রাক্তন কোচ কার্লো আনচেলোত্তি যখন চেলসির দায়িত্ব নিয়েছিলেন, মালদিনিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর সহকারী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে। সরকারি বক্তব্য পাওয়া যায়নি, কিন্তু মালদিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণও করেননি। হয়ত নয়, নিশ্চিতই জানিয়েছিলেন, অন্য কোনও ক্লাবের জার্সিতে থাকব না বলেই তো কোচিং নাকরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম!

পাঁচবার ইউরোপসেরা আর সাতবার স্কুদেতো ছাড়াও এসি মিলান তাঁকে যা দিয়েছে তিন নম্বর জার্সি। তাঁর অবসরের পর ঘোষণা করেছিল, মিলানে লালকালো তিন নম্বর জার্সি আর কারও পিঠে থাকবে না। পরে, ঠিক হয়, পাওলোর ছেলেদের মধ্যে কেউ যদি মিলানের জার্সি পরার যোগ্যতার্জন করে, দেওয়া হতে পারে। না হলে সেই তিন নম্বর জার্সি চিরতরে অবসরে। নিয়ম মেনে গত ১৬ বছরে তাই আর কারও পিঠে দেখা যায়নি লাল-কালো তিন।



অবসর নেওয়ার বছর দুই আগের ঘটনা। এসি মিলান খেলছিল বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে। খেলাটা দেখেছিলেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।পরে প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ৯০ মিনিট মাঠে ছিল, একবারও ট্যাকল করতে দেখিনি। ডিফেন্ডার হিসাবে কোন সারিতে ওঁর উপস্থিতি বোঝাতে যথেষ্ট।

ট্যাকলে গেলে বল নিয়েই ছাড়তেন সাধারণত। তবু, ট্যাকল সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, যদি ট্যাকলে যেতেই হয়,বুঝতে পারি, আগেই আমি পরাজিত, তাই না?

সেবাস্তিয়ান রোসি, দিদা বা জিয়ানলুকা পাগলিউকা, যাঁরা ছিলেন মালদিনের পেছনে তিনকঠির তলায়, জানতেন, পূর্বানুমান ক্ষমতার সদ্ব্যবহারে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় হাজির থাকাই ডিফেন্ডারের সবচেয়ে বড় কাজ। যে ডিফেন্ডারকে বারবার ট্যাকলের কড়া রাস্তায় যেতে হয় সে আবার ডিফেন্ডার কেন! আর সেই কারণেই তো নাইকি- সেই বিজ্ঞাপনটা যেখানে মালদিনির ছবি দিয়ে বলা হয়েছিল ইতালির গোলরক্ষক হওয়াটাই সবচেয়ে সহজ কাজ ইউরোপে

মালদিনি যে সেই ডিফেন্ডার, যাঁর অভিধানে কড়া ট্যাকল নেহাৎ অপ্রয়োজনীয়। তাই সেই ফুটবলারকে মনে পড়লেও 'অকারণ হরষ!