Monday, June 9, 2025

‌কাশীনাথ ভট্টাচার্য /‌ ক্রিস্তিয়ানো যদি লিখতেন লামিনেকে.‌.‌.‌


প্রিয় লামিনে,

তোর জন্মের আগে আমার ইউরোর ফাইনাল খেলা হয়ে গিয়েছিল, বিশ্বকাপেও খেলেছিলাম। ছেলে ক্রিস্তিয়ানো জুনিয়রের চেয়ে মাত্রই তিন বছরের বড় তুই। তাই তুই–‌ই বলছি। জানি, মনে করবি না কিছু। এইটুকু অধিকার অন্তত এই চল্লিশ বছরের লোকটার আছে, তাই না?‌

নেশনস লিগের ফাইনালে প্রথম খেললাম তোর বিরুদ্ধে। লোকে কত কিছু বলছিল। লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল মিডিয়াও। নেশনস লিগ ফাইনাল নাকি তোর আর আমার মধ্যে!‌ সারা জীবন শুনে এলাম এমন। ফুটবল যে দলগত খেলা, মিডিয়া বোঝে না। তাই এভাবে লড়িয়ে দিতে চায়। তোর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে যার নাম, সেই লিওনেলকে বিপক্ষে পেলে তো আর কথাই নেই! কত ম্যাচ খেলেছি পরস্পরের বিরুদ্ধে। হারজিৎ আছে, থাকবেও। কিন্তু মিডিয়া আমাদের যুদ্ধ‌ লাগিয়েও বসে থাকেনি। মাথা খুঁড়ে কী সব আজগুবি তথ্য বের করেছে, আর এমনভাবে তুলে ধরেছে আমাদের মন্তব্যগুলো, মনে হবে যেন একে অপরের সবচেয়ে বড় শত্রু!‌

এত বছরের অভিজ্ঞতা এবং তোর বাবার বয়সী হওয়ায় পরামর্শ দিতেই পারি — এই তুলনাগুলো নিয়ে কখনও মাথা ঘামাবি না। ওদের, মানে মিডিয়ার, জায়গাটা আমাদের ফুটবলারদের সাজঘরের বাইরে তো বটেই, মাঠেরই বাইরে। কাচ দিয়ে ঘেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বক্সে বসে ওদের কাজ। করে যেতে দে। তুই থাক তোর ফুটবল নিয়ে।

আসলে, রবিবার রাতে খেলা শেষে তোর উদাস চাউনি বড্ড মনখারাপ করে দিয়েছিল। সবাই জানে আমি কেঁদে ফেলি সহজেই। বহুবার কেঁদেছি হেরে গিয়ে, এমনকি হারের সম্ভাবনাতেও। তুই কিন্তু মহাদেশীয় ফাইনাল হেরেও কাঁদিসনি। চোখদুটো তোর বড় মায়াভরা। এক–‌আকাশ দৃষ্টি নিয়ে তাকাস। ওই যে ডানদিক থেকে কাট করে ভেতরে ঢুকে আসিস, বড় বক্সের মাথা থেকে কখনও জোরালো সোয়ার্ভিং শট নিস, বা কখনও আউটস্টেপ দিয়ে দূরের পোস্টে উঁচু করে বল ফেলিস — দেখেছি সব। চোখদুটো আরও চকচক করে ওঠে তখন। বয়স কম, এখনও তো কিশোরই। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বয়সও হয়নি। উৎসাহ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক, তোর আছেও। কিন্তু সেই চোখদুটোই দেখেছিলাম ফাইনালের পর ব্যথাতুর। একটা কথাও বলিসনি, কিন্তু কত কিছু লেখা ছিল ওই চোখে। তোর হতাশা, তোর বিষাদ। কী মায়ায় যে জড়িয়ে ফেললি!‌


আমার প্রথম বড় ফাইনাল ইউরোয়, ২০০৪ সালে। লিসবন, আমার দেশেই, এস্তাদিও দা লুজ স্টেডিয়ামে। তখন সবে উনিশ পেরিয়েছি। তুই জানিস না, কী টিম ছিল সেবার আমাদের। লুইস ফিগো ক্যাপ্টেন, রুই কোস্তা মাঠে আসত পরিবর্ত হিসাবে, রিকার্দো কার্ভালিও, পাউলেতা, দেকো। কোচ ছিলেন ফেলিপে স্কোলারি, আমরা যাঁকে ফেলিপাও বলতাম। নিজেদের দেশে ফাইনাল, সামনে গ্রিস, জিতব ভেবে নিয়েছিলাম সবাই। দেশকে প্রথম বড় ট্রফি দেব, দেশের মাটিতেই, আত্মবিশ্বাসে চনমনে দল। অথচ, ম্যাচটা ০–‌১ হেরে গিয়েছিলাম। ৫৭ মিনিটে গোল খেয়ে আমরা শোধ দিতে পারিনি। ম্যাচের শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম মাঠেই। এখনও ভাবলে চোখে জল আসে। আটকাতে পারি না, এত বছর পরও।

তাই তোকে দেখে ভাল লেগেছিল। একবারও চোখ মুছলি না, দু–‌হাতে চোখ ঢাকলিও না। ক্যামেরার দিকে না–‌তাকালেও দৃষ্টিতে কাঠিন্য আর উদাসীনতা মিলেমিশে। বুক–‌খালি করে দেওয়া চাউনি। রিজার্ভ বেঞ্চে বসে–‌থাকার সময় তোদের ওই জোব্বার মতো জ্যাকেটটা জড়িয়েই হাঁটছিলি মাঠে। হাত মেলাচ্ছিলি আমাদের সঙ্গে, তোদের ফুটবলারদের সঙ্গেও। কিন্তু প্রাণ ছিল না। যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলি। শরীরটা নড়ছিল, মন ছিলই না আর অ্যালিয়াঞ্জ এরিনায়। আলবারোর (‌মোরাতা)‌ পেনাল্টি মিসের পর থেকেই তুই তখন অন্য জগতের বাসিন্দা।

কষ্টটা বুঝি রে। কালে কালে বয়স তো আর কম হল না! সেই যে ইউরো ফাইনালে হারের কথা বলছিলাম। তোর চেয়ে মাত্রই দু–‌বছরের বড় ছিলাম তখন। তবুও তো তোর বিরাট সান্ত্বনা আছে, নেশনস লিগের আগেই, গত বছর, ইউরো দিয়েছিস দেশকে। আমাকে যা পেতে ২০১৬ পর্যন্ত, মানে নিজের একত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তা–‌ও আবার সেই ফাইনালে আমি সাত–‌আট মিনিটের পর থেকেই দর্শক। দিমিত্রি পায়ে–‌র ট্যাকলে চোট পেয়ে চোখের সামনে যেন বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মনে হয়েছিল। কতটা কেঁদেছিলাম, তোরা ইউটিউব–‌বেবি, ইন্টারনেটে চাইলেই দেখে নিতে পারবি।‌ তোর হতাশা কম হবে সতেরয় ইউরো জিতে ফেলেছিস বলে। আমাদের যন্ত্রণাটা বোঝার বয়স এখনও হয়নি তোর।

স্নেহের পরামর্শ দিই দুটো। এক, মনের আনন্দে খেলবি, যেমন খেললে তোর ভাল লাগবে সেভাবেই। আর দুই, মাঠে কোনও প্রতিপক্ষ যদি এক–‌দু’‌বার পেরিয়ে বা বোকা বানিয়ে চলে যায়, হতাশ হবি না। এই দ্বিতীয় পরামর্শের কারণ, ফাইনাল থেকে দ্বিতীয়ার্ধে তোর হঠাৎ হারিয়ে–‌যাওয়া, আমাদের নুনো মেনদেস তোকে দুবার পেরিয়ে যাওয়ার পর। আমাকে গোলের পাসটা বাড়ানোর সময়, আক্রমণ শুরু করেছিল নুনো তোর পাশ থেকে ছিটকে বেরিয়েই। তুই যেন নিভে গেলি দপ্ করে। দৌড়লি না আর তারপর। হারিয়ে ফেললি স্বাভাবিকতা। কেন?‌

পারলে আমাদের সময়ের এল ক্লাসিকোগুলোর ভিডিও দেখিস। তখন আমার বয়স কম। ফিটনেস দুরন্ত। তোর বার্সেলোনায় তখন আমাকে আটকানোর দায়িত্বে থাকত দানি (‌আলবেস)‌। আমিও অমন ছিটকে বেরতাম। আর একবার পেরিয়ে গেলে আমাকে ধরা যেত না তখন। দানি কিন্তু অদ্ভুত নাছোড়বান্দা। পাঁই পাঁই করে ছুটে আসতে পেছন পেছন। কখনও বা কাট করে ভেতরে ঢুকে আসত, বক্সের মাঝখানে আমার বাড়ানো বলটা আটকাতে। আবার কখনও পেছনে ছুটে আসতে আসতেই শরীরে ঢুকে ট্যাকল করত, পা ছুড়ে দিত। বয়স আর একটু বাড়লেই তুই বুঝবি, ছেড়ে দেওয়া যায় না। ফুটবল এমনই, নিরন্তর চালিয়ে যেতে হয় চেষ্টা। আর শিখতে হয় প্রতি পদে। দাঁড়িয়ে পড়বি না কখনও, ছেড়ে দিবি না, হারিয়ে যাবি না।


ঠিক এক বছর পর বিশ্বকাপ। জানি না, সুস্থ থাকব কিনা, খেলতে পারব কিনা। চেষ্টা করব অবশ্যই। তুই, তোরাও চেষ্টা করবি। তোদের দেশের সঙ্গে আমার দেশের লড়াই তো বহুযুগের। শুনেছি, আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন স্পেনে ঢুকেছিল, স্পেনীয়রা নাকি তাদের ঢুকতে দিয়েছিল সহজেই। যাত্রাপথে বাধা দেয়নি। তারপর আইবেরীয় উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে যখন পৌঁছয় পর্তুগিজরা, তিন দিক সাগর দিয়ে ঘেরা ছিলই, চতুর্থ দিকটা বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল স্পেন। আমাদের ঘিরে দেওয়া হয়েছিল তিনদিকে জল দিয়ে। নেশনস কাপ ফাইনালে আমরাও তোদের শুরুতে ওভাবেই ওপরে উঠতে দিয়েছিলাম, আমাদের ডিফেন্সিভ থার্ডে। ভবিষ্যতেও হয়ত একই রকম করব। তত দিনে তোদেরও অভিজ্ঞতা বাড়বে আরও, শিখে যাবি কী করে সেই চক্রব্যুহ কেটে বেরতে হয়। সামনের বছরই হয়ত আবার দেখা হবে আমাদের, বিশ্বকাপের আসরে। আরও আকর্ষণীয় হবে সেই লড়াই। তত দিন এভাবেই খেলে যা, আমাদেরও মন্ত্রমুগ্ধ করে যা। 

সামনের ১৩ জুলাই তুই আঠের। শুভেচ্ছা রইল। ফাইনালের ফার্স্ট হাফ–‌এর পর তোর বন্ধু নিকো আমার জার্সিটা চেয়ে নিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে তাই অন্য জার্সি পরেছিলাম। ওই দিন ওই দ্বিতীয় জার্সিটা সই করে পাঠাব তোকে, বড় হওয়ার দিনের উপহার হিসাবে।

ভাল থাকিস, আশীর্বাদ নিস।

তোর পিতৃসম

ক্রিস্তিয়ানো


12 comments:

Anonymous said...

অসাধারণ। এই চিঠিটা যদি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে পাঠানো যেতো, তাহলে দারুন হতো।

kashibhatta said...

ক্রিস্তিয়ানোর মাতৃভাষা পর্তুগিজ আর লামিনের স্প্যানিশ। তাইলে দুই ভাষাতেই করতে হতো যে, কত খাটনি, উফফফ :)

Anonymous said...

সত্যিই এই লেখাটি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে পাঠানোর মতো, খুব ভালো লাগলো

Anonymous said...

Awesome 👍

Anonymous said...

চমৎকার

kashibhatta said...

এহানে হগ্গলে ‘অ্যানোনিমাস’ কেন, বুইজবার পাইতেসি না !!

Anonymous said...

অসাধারণ লেখা কাশিদা।

Manansil said...

লামিনে ম‍্যাচটা হেরে হয়তো হতাশ ছিল। কিন্তু যখন ওর বয়স হবে, পরের প্রজন্মকে বলতে পারবে “আমি ক্রিশ্চিয়ানোর সাথে খেলেছি”।

kashibhatta said...

‘বিরুদ্ধে’ খেলেছি বলবে তো! হ্যাঁ, ওঁর বিরুদ্ধে খেলাটাও বিরাট প্রাপ্তি :)

Amitava Basu said...

লেখাটা খুব ভালো লাগলো , বিশেষ করে " সিআর7 " এর ওই পর্যবেক্ষণ যে নুনো মেনডেজ পাস দিয়ে ছিটকে বেরোবার পর লামিনে কিরকম যেন নিষ্প্রভ হয়ে ম্যাচ থেকে বেরিয়ে গেলো, যেন হাল ছেড়ে দিলো, স্নেহের উপদেশ আর নিজের অভিজ্ঞতা ছোটদের দিয়ে যাবার প্রচেষ্টা, আমার প্রিয় ফুটবলারকে আর মহীয়ান করে তুলেছে 😊। আমার কাছে সিআর7 সারা মাঠ জুড়ে খেলা আর প্রচণ্ড ভার কাঁধে নিয়ে সফল হওয়া সেরা ফুটবলার।

kashibhatta said...

চাপ কাঁধে খেলাই তো বড় হওয়ার বড় কারণ। বড়-দের জন্য স্বাভাবিকও :) আরও ভাল লাগল পরিচয় লুকিয়ে রাখেননি বলে। অজস্র ধন্যবাদ :)

Saugata Chowdhury said...

কাশীদা দারুণ লিখেছো, রোনাল্ডোর সত্যি ই এমন ফাদার ফিগার হয়ে ওঠার ই কথা।