** আজ আটত্রিশ পূর্ণ করলেন। জন্মদিনে ফিরে-দেখা ১৫ বছর আগের লেখায়
বল ছিনতাইয়ে ছলই বল! সেখানে আকাশি–সাদা ডোরা, পিঠে দশ নম্বর, নিজের লক্ষ্যে অবিচল
I am not Christ or a philanthropist, old lady, I am all the contrary of a Christ... I fight for the things I believe in, with all the weapons at my disposal and try to leave the other man dead so that I don't get nailed to a cross or any other place.
— Che Guevara
রোজারিওয় জন্ম এরনেস্তো চে গেভারার, ১৪ জুন ১৯২৮।
রোজারিওতেই জন্ম লিওনেল মেসির, ২৪ জুন ১৯৮৭।
একই শহর, একই মাস, মাঝে ৫৯ বছর শুধু!
ছোট্ট চে ভুগত অ্যাকিউট অ্যাজমায়, সারা জীবনই ভুগেছিলেন। খেলার প্রতি ভালবাসা কমেনি তাতে। বুয়েনোস আইরেসে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাগবি দলের সদস্য, খেলতেন আগ্রাসী ‘ফ্লাই–হাফ’ হিসেবে। ভালবাসতেন ফুটবল, সাঁতার আর দাবা। মোটরসাইকেলে লাতিন আমেরিকা দেখতে বেরিয়ে পড়েন যিনি দু–দুবার, অ্যাজমা তাঁকে আটকে রাখতে পারে কখনও? আর, দক্ষিণ আমেরিকার শোষিত–নিপীড়িতদের দিশা দেওয়ার ভার যিনি স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেবেন পরে, হয়ে উঠবেন পরিত্রাতা কোটি কোটি মানুষের, তুলনায় খেলার ছোট জগতে কী করেই বা নিজেকে সীমাবদ্ধ থাকতে পারতেন আর্জেন্তিনার সেই ক্ষণজন্মা?
ছোট্ট লিও ভুগত বেড়ে–ওঠার হর্মোনের স্বল্পতায়। কিন্তু, সে তো বাবা–মা, চিকিৎসকদের চিন্তা। তাতে কি আর ফুটবলের প্রতি ভালবাসা কমে? রিভারপ্লেট তাকে না নিল তো বয়েই গেল! লা মাসিয়া আকাদেমি তো বসেছিল হাত বাড়িয়েই, বার্সেলোনায়। চিকিৎসার দায়ভার নিয়ে নিলে যদি ভবিষ্যতের পরিত্রাতাকে পাওয়া যায় ফুটবল মাঠে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তিই বা আর কী?
ব্যস্, সাদৃশ্য–অনুসন্ধান পর্ব এখানেই শেষ। চে–র প্রভাব বা চে–র ব্যপ্তির সঙ্গে লিওনেলের প্রভাব কোনওভাবেই তুলনীয় হতে পারে না, জীবনের মাঠে চে কত গোলে হারাবেন লিওনেলকে, সেই সংখ্যা নিয়ে জল্পনা চলতে পারে, হার নিয়ে একেবারেই নয়। লম্বা চুল, খোঁচা দাড়ি, মাথার টুপিতে তারা চিহ্ন — আলবের্তো কোর্দার তোলা চে–র সেই ছবি আজও বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত। ‘বিপ্লব সেই গাছ–পাকা আপেল নয় যা নিজের ভারে মাটিতে এসে পড়ে, বিপ্লবকে পেরে আনতে হয়’, এমন সহজ করে বোঝাতেই বা পেরেছিলেন কে কবে কোথায়?
মেসির ধান ভানতে চে–র গীত গাওয়ার মানে একেবারেই এই নয় যে, চে–র মতোই প্রভাবশালী হিসেবে মেসিকে চিহ্নিত করার ‘বৈপ্লবিক’ প্রয়াস! একই শহরে জন্মানো দুই প্রতিভা সম্পর্কে কিছু মিল, আর হ্যাঁ, অনেক ছোট স্তরে হলেও যা কোনও মতেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না আর, সমকালীন ফুটবলে লিওনেলের প্রভাব। মেসি তো সেখানে লড়ছেনও চে–র অস্ত্রেই, চে–র শেখানো রাস্তায়!
জন লি অ্যান্ডারসনের বই ‘চে গেভারা — এ রিভোলিউশনারি লাইফ’–এ মা–কে চিঠিতে লিখেছিলেন চে সেই কথাগুলো যা এই লেখার একেবারে শুরুতে উদ্ধৃত। ‘... যা বিশ্বাস করি তার জন্যই লড়ি। আমার হাতে যা অস্ত্র আছে তাই নিয়েই। চেষ্টা করি বিপক্ষের মানুষটাকে মেরে ফেলতে, যাতে পরে তার হাতেই কোনও ক্রস বা অন্য কোথাও আমার মৃত্যু না হয়’। মানবপ্রেমী যিশু বা তাঁর ক্রুসিফিকেশন সম্পর্কে ‘ওল্ড লেডি’ মা–কে চে–র ব্যাখ্যা।
বৃত্তটাকে ছোট করে ফুটবল মাঠে নিয়ে আসুন, মেসিকে দেখতে পাচ্ছেন না? তাঁর হাতে (এখানে পায়ে) যা যা অস্ত্র — বল নিয়ন্ত্রণ, বল–দক্ষতা, ড্রিবল, যে কোনও অবস্থান থেকে যেখানে খুশি বল পাঠানোর ক্ষমতা, গতি, শরীরের ভাঁজ, ছন্দ, সৌন্দর্য — দিয়েই তো চেষ্টা করে চলেছেন তাঁর বিপক্ষকে ‘মেরে’ ফেলতে, মানে হারাতে আরও একটা ম্যাচে। তাঁর বিশ্বাস থেকে নড়েননি। ফুটবল খেলতে হলে বল–পায়েই খেলতে হবে। বল–ছাড়া ফুটবল খেলা হয় না, তা নয়। কিন্তু, তাতে তাঁর আস্থা নেই। তিনি বল চাইবেন পায়ে, তিনিই তৈরি করবেন মুহূর্ত, সেই মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দি হয়ে আশ্রয় নেবে আমাদের মনোমন্দিরে, আমরা পাতা ওল্টাব অবসরে, দেখব সেই ছবিগুলোই আবার, বার বার।
তাঁর বিপক্ষে কত কত কোট–টাই পরিহিত বেঞ্চে–বসা লোক! তাঁরাও রোজ ভেবে চলেছেন, কী করে আটকে দেওয়া যায় তাঁকে, মেরে ফেলা যায় ফুটবল নামক ওই গোলকের আকর্ষণ। এক–দুই–তিন–চার–অসংখ্য পায়ের জঙ্গলে প্রতি পদে আপদ–বিপদ, পদস্খলনের সম্ভাবনা তৈরি রাখতে রাতের ঘুম বরবাদ। ভয় আছে মনে, তাই এত চিন্তা। ভয়ই যে নেতি–র জন্মস্থান। সেই নেতি–কে ইতিবাচক ছাপ দিতে নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা। আসলে তো, ওভাবে হারলে ‘আমার যে কী হবে’! আমি কোচ, কিছুই করতে পারব না? গড়তে না হয় নাই–বা পারলাম, ভাঙতে ক্ষতি কী? বিশ্বকাপ যেন সামনে একটাই লক্ষ্য রেখে ছুটছে। না, জেতার লক্ষ্যে নয়। কী করে রোজারিও–র মেসিকে রোজ খেলতে না–দেওয়া যায়, কী করে আটকে দেওয়া যায়, মেরে–ধরে, কৌশলে।
কিন্তু, পারা যাচ্ছে না। গেরিলা যুদ্ধ চলছে। চোরাগোপ্তা লাথি–ঘুষি–কনুই বর্ষণ। বল ছিনতাইয়ে ছলই বল! সেখানে আকাশি–সাদা ডোরা, পিঠে দশ নম্বর, অবিচল নিজের লক্ষ্যে। নিজের অস্ত্রে শান দিচ্ছেন রোজ। কখনও পা–ছুরির তীক্ষ্ণতায় ঝলসে যাচ্ছে চোখ, কখনও পায়ে তুলে নিচ্ছেন তুলি। মেঘনাদ হয়ে মেঘের আড়াল থেকে নয়, তাঁর যুদ্ধ সূর্যের আলোয়, সরাসরি, সামনাসামনি। ‘আমার পায়ে বল, বুকেও। কেড়ে দেখাও’, ছুড়ছেন চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিতে বাকিরা ছুটছেন আইনের পথ এড়িয়ে, চোরাগলি দিয়ে!
জীবন তো এমনই। সবাই সুন্দরের পূজারী হতে পারেন না, কুৎসিত–এরও ‘প্রোমোটার’ থাকেন, এই বিশ্বেই।
তবু, নিকষ কালো রাত পেরিয়ে, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে’ — মেসি!
প্রকাশিত : আজকাল, বিশেষ বিশ্বকাপ সংখ্যা, ১ জুলাই ২০১০
No comments:
Post a Comment