মাত্র তিন বছর একসঙ্গে
ছিলেন মেসি ও রোনালদো।
ঠিক একসঙ্গে নয়, একই ছাতার তলায় — নাইকি!
অ্যাডিডাস উঠে এসেছিল বহু বছর আগে। জনৈক জার্মান
অ্যাডলফ অ্যাডি ড্যাসলারের নেতৃত্বে, বাভারিয়ার হেরজোগেনাউরাখ শহরে। অ্যাডির ভাই ছিলেন রুডলফ। ১৯৪৮ সালে তাঁদের মনে হয়েছিল,
আলাদা হওয়া জরুরি। ভাই অ্যাডির
সঙ্গে টক্কর দিতে রুডলফ তখন খুলেছিলেন
‘পিউমা’। দুই সংস্থার
লড়াইয়ে এগিয়ে গিয়েছিল
অ্যাডিডাস, ১৯৫৪ বিশ্বকাপ
ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি
দলকে এমন বুট দিয়ে যার স্টাডগুলো
আলাদা করা যেত। সেই ফাইনালে
হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাসদের
বিরুদ্ধে বৃষ্টিস্নাত মাঠে বিরতিতে
জার্মান কোচ হারবার্জার বলেছিলেন অ্যাডিকে, ‘স্ক্রু দেম ইন!’
বিশ্ব ফুটবলে বুটের ইতিহাস বদলে গিয়েছিল
তারপর।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি
উত্থান নাইকি–র, ফুটবলেও।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার
বিশ্বকাপের পর থেকে নাইকির কর্তাদের
ভাবনায় ঢুকে পড়েছিল ফুটবলও।
অ্যাডিডাস–পিউমার দ্বৈরথে
জমি খুঁজছিল যদিও। নতুন সহস্রাব্দে তাদের হাতে এসেছিলেন
দুই তরুণ। পর্তুগিজ ক্রিস্তিয়ানো ও আর্জেন্তিনীয় লিওনেল। ২০০৩ সালে ক্রিস্তিয়ানো তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন
সদ্য, এফসি বার্সেলোনায় ঠিক নয়, লা মাসিয়ায় এসে পৌঁছেছেন
মেসিও। দুটি ক্লাবের
সঙ্গেই যুক্ত ছিল নাইকি। দুই কিশোর —
ক্রিস্তিয়ানো তখন ১৮, লিওর ১৬ — সই করে ফেলেছিলেন
নাইকির সঙ্গে চুক্তিতে।
হ্যাঁ, রজার ফেডেরার
আর রাফায়েল নাদালের মতো, নাইকির মালিকানা
ছিল ফুটবলে ভবিষ্যতের দুই ‘গোট’–এর, ‘গ্রেটেস্ট
অফ অল টাইম’।
ছোট্ট একটা ভুলে ২০০৬ সালে নাইকি হারায় মেসিকে।
বাবা হোরখে কিছু বুট এবং সরঞ্জাম
চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। নাইকির দায়িত্বে–থাকা কর্তারা
আমল দেননি। সেই সময় মেসির চুপচাপ স্বভাব নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না কর্তারা।
কথা বলেই না বিশেষ, আগ্রাসন
নেই, ভবিষ্যতে আগল খুলে বেরবে কিনা সন্দিহান।
বাবা–মেসি অবশ্য সুযোগ হাতছাড়া
করেননি। ‘ঠিক আছে, নাইকিই তো একমাত্র
সংস্থা নয় যারা উঠতিদের
স্পনসর করে’ ভেবে অ্যাডিডাস
শিবিরে যোগাযোগ এবং মেসি গত প্রায় ১৯ বছরে এখন অ্যাডিডাসের ‘আজীবন’ সদস্য, ঠিক যেমন ক্রিস্তিয়ানো নাইকির। ফুটবলের কোক বনাম পেপসি লড়াই!
দুই সাংবাদিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের। জোশুয়া রবিনসন ও জোনাথন ক্লেগ, ওয়াল স্ট্রিট
জার্নালে লেখেন, প্রধানত
ইউরোপীয় ফুটবল নিয়ে। ‘মেসি ভার্সেস
রোনালদো’ তাঁদের কথা যা বইয়ের আকার পেয়েছে হারপার কলিন্সকে
প্রকাশক হিসাবে পেয়ে। ৩০৮
পাতা, ভারতীয় মুদ্রায়
মাত্র ৫৯৯ টাকায় এমন বই যা দুই ‘গ্রেটেস্ট
অফ অল টাইম’ ফুটবলারের উত্তরণের
ইতিহাস শোনায় নিষ্ঠাভরে।
গবেষণার অর্থ, বাংলা প্রকাশনা
জগৎ এখন মনে করে, পুরনো পত্রপত্রিকা বা দৈনিক সংবাদপত্র
থেকে ‘টোকাটুকি’। ‘মেসি ভার্সেস
রোনালদো’ যদি ভুল করে তাদের হাতে কখনও পড়ে যায়, টোকাটুকির
‘রিসার্চ’–এর ভূত মাথা থেকে বেরিয়ে হয়ত পৌঁছে যাবেন তাঁরাও, সেই উত্তরণের রাস্তায়!
মেসি-রোনালদো মানে আজকের ট্রোলিং
(অ)সভ্যতা! কার কত গোল, কত অ্যাসিস্ট,
ক’টা পেনাল্টি গোল, ‘কম্পিটিটিভ’ আর ‘ফ্রেন্ডলি’ ম্যাচ ইত্যাদি
নানারকমের প্যারামিটার ধরে কার ভক্তরা অন্য শিবিরকে
টেনে নামাতে পারেন তার প্রতিযোগিতা সমাজমাধ্যমে। নীচতায় গা-ঘিনঘিনে।
তখনই হাতে এসে পড়ে ‘মেসি ভার্সেস
রোনালদো’।
দুই লেখক ভূমিকায় যথার্থ বলেছেন,
‘দুই ফুটবল জিনিয়াস একই সময়ে খেলে কী করে খেলার দুনিয়াটাকেই বদলে দিলেন দ্রুত, তারই উপাখ্যান
মেসি ভার্সেস রোনাল্ডো।
দুজনে শুধুই সেই প্রিজম নয় যার মধ্যে দিয়ে আধুনিক ফুটবল বোঝার চেষ্টা করবেন, মাত্র তিন ডজনবার পরস্পরের
মুখোমুখি হয়েই তাঁরা ক্রীড়াবিশ্বের ব্যবসা এবং সংস্কৃতির
ইকোসিস্টেমকে যেভাবে প্রভাবিত
করলেন, নিজেরা বিন্দুমাত্র না-জেনে এবং না-বুঝেই, সেই প্রক্রিয়াটাকেই বোঝার চেষ্টা।’
বোঝার এবং বোঝানোর
সেই চেষ্টায় সামিল হয়েছেন দুই সেরার
ক্লাব ও দেশের সতীর্থরা
যেমন, কর্তারাও, যাঁরা তাঁদের নিয়েছেন,
আদর করে সর্বোচ্চ অঙ্ক দিয়ে রেখেছেন
দলে বা বেচেও দিয়েছেন সময়–সুযোগ–অর্থ পেয়ে। ফুটবল-বিশ্ব কীভাবে তাঁদের হাত ধরে আর্থিক চাপানউতোর-এ শেষ পর্যন্ত
পরের প্রজন্মের কাছে খুলে দিয়েছে আরও বেশি রোজগারের
রাস্তাটা, ‘শুধুই আরও আরও ভাল খেলে’, সেই যাত্রাপথের মনোরম ধারাভাষ্যও এই বই। আর আছে দুজনের দুই ‘হোরখে’ নামক এজেন্ট-এর গল্প। এক হোরখে মেসির বাবা, অন্যজন
মেনদেস, পর্তুগালে যিনি এক সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে হয়ে উঠেছেন ফুটবল-বিশ্বে বিরাট নাম,
তাঁর ক্লায়েন্ট-এর মতোই।
‘মারাদোনার
থেকে ভাল হবে কিনা জানি না, তবে, লম্বা হবে, নিশ্চিত!’
বক্তা দিয়েগো সোয়ারজস্টেইন। পদবি থেকে পরিচয়ের
উৎসসন্ধানে গেলে জার্মানি
খুঁজে পেতেই পারেন। আর্জেন্তিনায় যা স্বাভাবিক। ইতালীয় বংশোদ্ভুত
সবচেয়ে বেশি। স্পেন, জার্মানি,
ইংল্যান্ড ইত্যাদি ইউরোপীয়
দেশ থেকেও বহু মানুষ গিয়েছিলেন। তাঁদের উত্তরসূরিরা এখন স্থায়ী বাসিন্দা।
জার্মান পূর্বপুরুষ যাঁর, সেই সোয়ারজস্টেইন ছিলেন চিকিৎসক। নিওয়েলস
ওল্ড বয়েজ-এর ভক্ত সেই চিকিৎসকের
নিদান ছিল এগার বছর বয়সী লিওনেলের
জন্য, ‘গ্রোথ হর্মোন’
চিকিৎসা। জার্মান সেই নিদান মেনেই আজ সেই আর্জেন্তিনীয় বিশ্বসেরা!
চিকিৎসার খরচ বহন করতে আর্জেন্তিনীয় ক্লাবগুলো অরাজি। বার্সেলোনায় ভবিষ্যৎ-সন্ধানে গিয়ে ১১ দিন অপেক্ষার
পর কার্লোস রেক্সাচ নামের সেই জহুরির সামনে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এবং আপ্লুত রেক্সাচের
সময় নষ্ট না করে লিওনেলকে
কাগজের ন্যাপকিনে সই করিয়ে নেওয়ার গল্প বহুশ্রুত।
কিন্তু, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সইপর্ব এবং তার প্রেক্ষাপট?
ঘটনা তার এক বছর আগের। হোর্খে মেন্দেজ
‘এজেন্ট’ হিসাবেও অনভিজ্ঞ।
পর্তুগিজ হোরখের সঙ্গে কথা হয়েছিল কার্লোস
কুইরোজের। রিয়াল ভায়াদোলিদ
থেকে রিকার্দো নামের গোলরক্ষককে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে পাঠাবেন,
আশায় ম্যানচেস্টারে হাজির হওয়ার কথা, ইউরোপীয়
অন্য এজেন্টদের সঙ্গে। যে দিন ম্যানচেস্টারে যাওয়ার কথা, আগের রাতে মাদ্রিদ
থেকে পোর্তোয় ফিরছিলেন
হোরখে। গাড়িতে সবান্ধবী।
রাস্তায় হোরখের গাড়ির সামনে একটি ট্রাকের
অ্যাক্সেল ভেঙে যায় হঠাৎ। সোজা ধাক্কা এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার
পাশে ধাক্কা মারার আগে গাড়ি ততক্ষণে
নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল।
উদ্ধার করা হয়েছিল দুজনকেই।
হোরখেকে যখন হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়া হয়, ডাক্তারদের বলেছিলেন, ‘সময় নেই, আমাকে ছেড়ে দিন, পরে ফিরে বলব’, জানিয়ে বিস্মিত
ডাক্তারদের সামনে থেকে প্রায় দৌড়ে সামনের ফার্মেসিতে গিয়ে গজ কিনে কানে চাপিয়ে সোজা বিমানবন্দর। দামী সুটে রক্তের ফোঁটা যদিও তাঁর বিমানযাত্রার অন্তরায় হয়নি!
সেবার প্রথম দেখা অ্যালেক্স
ফার্গুসনের সঙ্গে। কথা বিশেষ হয়ইনি। পরেরবার
হোরখে অবশ্য আত্মবিশ্বাসে ঝলমলে। ফার্গুসনকে বলেছিলেন,
‘রোনালদোকে দিতে পারি, তবে ফিফটি পারসেন্ট
প্লেয়িং টাইমের নিশ্চয়তা
দিতে হবে।’ স্কটিশ ফার্গুসনের চোয়াল শক্ত, মুখ আরও লাল। বলা হয়, এজেন্টদের
সঙ্গে দরাদরির সময় নাকি ফার্জি রবিবারের
পর সোমবার হবে সেটাও মানতে চাইতেন না! এখানে দাবি তো
পঞ্চাশ শতাংশ খেলার সময়! ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বছরে গড়ে ৫৫ ম্যাচ খেলে। মানে ৯০ মিনিটের
হিসাবে ২৭-২৮ ম্যাচ পুরো খেলানো?
তা-ও আবার আনকোরা ছেলেকে যে সবে একটাই বছর পেশাদার
ফুটবলে খেলেছে?
ফার্জি জানিয়েছিলেন, ‘প্রিমিয়ার
লিগে ছ’টা ম্যাচে শুরু করবে, ব্যস।’ অর্থাৎ,
ছ’টা ম্যাচে ৯০ মিনিট খেলবে, এই নিশ্চয়তাও
দেননি! গাম্ভীর্য বলে দিয়েছিল,
হোর্খের সামনে একটাই অপশন। ‘হয় মেনে নাও নয় থ্যাঙ্কিউ!’
পর্তুগিজ সেই এজেন্ট মেনে নিয়েছিলেন। প্রিমিয়ার লিগে ছয় ম্যাচ মানে মাদেইরার
সেই তরুণের সামনে তখন নতুন বিশ্বের
দরজা খুলে যাওয়া। নিমরাজি
হয়েই সই। এমন আরও গল্প পাতায়পাতায়।
আসলে যেগুলো গল্পের মতো হলেও সত্যি। পড়তে পড়তে টুইটার-হোয়াটস্যাপের কালিমার পাঁক থেকে
পাঠক উঠে আসবেন পবিত্র-স্নানে!
বইয়ের সমস্যা একটাই। ইউরোপীয়
ফুটবল জগৎ থেকে বহু দূরে বসবাসের
কারণে কলকাতায় বইটি হাতে এসে পৌঁছয় ২০২৩-এর শুরুতে,
কাতার বিশ্বকাপে মেসি চ্যাম্পিয়ন এবং রোনালদো সৌদি আরবের ক্লাবে সই করে ফেলার পর। যেহেতু বই লেখা হয়েছিল কাতার বিশ্বকাপের আগে, মেসির সর্বোচ্চ সাফল্য এবং রোনালদোর
ক্লাব ও দেশের প্রথম এগারয় জায়গা না-পাওয়ার করুণ ইতিহাস এই বইয়ের অংশ হতে পারেনি।
অদূর ভবিষ্যতে আরও একটি অধ্যায় জুড়বে তাই, নিশ্চিত।
না-হলে এই বই যে অসম্পূর্ণ!
মেসি ভার্সেস রোনালদো
লিখেছেন – জোশুয়া রবিনসন ও জোনাথন ক্লেগ
হারপার কলিন্স, নিউ ইয়র্ক
দাম – ৫৯৯ টাকা
প্রকাশিত - খেলা, এপ্রিল ২০২৩
*বর্ধিত এবং বানান পরিবর্তিত
No comments:
Post a Comment