ফুটবল এমন আনন্দ যা কষ্ট দেয়!
জন্মসূত্রে দক্ষিণ আমেরিকান না হলে বোধহয় লেখা যায় না এমন। সেই দর্শকের কাছে জানতে চান। আনন্দ পেতে চেয়েই হাজির ছিল গ্যালারিতে। পরাজয়ের পর হারের অনিবার্যতায় স্তব্ধ, চলৎশক্তিহীন। ম্যাচ শেষ অনেকক্ষণ। বিরাটকায় কংক্রিটের জঙ্গলে বসে একা। তার দুঃখের তুলনা? ‘আমাদের’ বহুত্ব থেকে ‘আমি’-র একাকীত্বে নির্বাক অবতরণ!
এদুয়ার্দো গালেয়ানো উরুগুয়ের লেখক। তাঁর ‘ওপেন ভেইনস অফ লাতিন আমেরিকা’ পড়লে থমকে যেতে হয়। অদ্ভুত এক মনখারাপের আয়না। আর আমেরিকার দক্ষিণ অংশে জন্মালে যা অবশ্যম্ভাবী, ফুটবলপ্রেম। ভেসেছেন নিজে, তাই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পাঠকদের, তাঁর ‘ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বই-এর এক পাতা থেকে অন্য পাতায়, অন্য দুনিয়ায়, যেখানে ফুটবল ফুটে থেকেছে রৌদ্রছায়ায়, অপাপবিদ্ধ, অমলিন।
গালেয়ানোর লেখায় আনন্দবেদনা জড়িয়েমড়িয়ে থাকে, উইলিয়াম ব্লেকের বহুপঠিত কবিতার মতো, ‘রানস এ জয় উইথ সিল্কেন টোয়াইন’। তাঁর লেখা অপছন্দের তালিকায় উরুগুয়ের শাসকদের। পালিয়ে যেতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে। পাশের আর্জেন্তিনায় আশ্রয়। তখন আর্জেন্তিনা মিলিটারি জুনতা-র শাসনে। আটাত্তরের বিশ্বকাপের সময় ছিলেন কেম্পেসের দেশে। কিন্তু সেখানেও ‘ঠাঁই নাই’। অতঃপর স্পেনে এবং উরুগুয়ে যখন স্বৈরাচারী শাসকদের হাত থেকে মুক্ত, ফিরে এসেছিলেন।
তাঁর এই বিশ্বনাগরিক সত্তা বারবারই ফিরে এসেছে বইতে। প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন মাত্র কয়েকটি বাক্যে। কিন্তু, কী অমোঘ! ১৯৩৪ বিশ্বকাপের আগে যেমন, ‘চিনে তখন লং মার্চ শুরু করেছেন মাও। জার্মানিতে হিটলার থার্ড রেইখের ফুয়েরার ঘোষিত। আইন পাল্টাচ্ছেন আর্যদের সমর্থনে। আর, অপরাধজগতের জীবাণুমুক্তকরণ চলছে (গালেয়ানোর ভাষ্যে স্টেরিলাইজেশন অন ক্রিমিনালস!)! ইতালিতে সেই সময়ই বিশ্বকাপের উদ্বোধন করছেন মুসোলিনি।’ সমাজের সঙ্গে যে-খেলার যোগ সরাসরি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরের আগে বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থান জানিয়ে রাখাই তো ভাষ্যকারের কাজ। কৃতিত্ব অবশ্যই মার্ক ফ্রায়েড-এরও, গালেয়ানোর স্প্যানিশকে যিনি এমন সুপাঠ্য ইংরেজিতে তুলে ধরেছেন।
এবং বর্ণবৈষম্য। ১৯১৬ সালে প্রথম মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা শুরু লাতিন আমেরিকায়, কোপা। উরুগুয়ে প্রথমেই চিলেকে ওড়াল ৪-০। পরের দিন চিলের ফুটবল সংস্থা ম্যাচ বাতিলের দাবি জানাল। ‘উরুগুয়ে দুজন আফ্রিকানকে খেলিয়েছে’, অভিযোগে। সেই দুজন – ইসাবেলিনো গ্রাদিন ও হুয়ান দেলগাদো। দক্ষিণ আমেরিকায় বরাবরই ইউরোপীয় বংশোদ্ভুতদের বসবাস। গ্রাদিন এবং দেলগাদোর পূর্বপুরুষরা ক্রীতদাস ছিলেন। চিলের শ্বেতাঙ্গ কর্তারা কী করে মেনে নেবেন? দুই ‘আফ্রিকান’ আবার দু’টি গোলও করেছিলেন। তাই প্রতিবাদ। কান দেয়নি দক্ষিণ আমেরিকার নিয়ামক ফুটবল সংস্থা। কিন্তু, ঘটনার উল্লেখ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেই সময় মানুষের সামাজিক ও মানসিক অবস্থানের স্বরূপ। সেই লেখার শেষে আলাদা একটিই বাক্য, ‘তখন ফুটবলে উরুগুয়েই একমাত্র যাদের জাতীয় দলে খেলতে পারত কৃষ্ণাঙ্গরা।’
ফুটবল যদি নাটক হয়, কুশীলব শুধুই ফুটবলার বা ম্যানেজার অথবা দর্শক-সমর্থক নন। ফুটবল নিজেও সেই নাটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রেফারি তো বটেই। স্পেনীয় ভাষায় রেফারি হলেন ‘আরবিতরো’, স্বৈর। ‘স্বৈরাচার (ডিকটেটরশিপ) চালিয়ে যাচ্ছেন, বিরোধীশূন্য। এই অপেরায় তিনিই পরম ব্রহ্ম। অথচ, ওঁর কাজই হল নিজেকে হাস্যাস্পদ বা ঘৃণ্য করে তোলা। ওঁর প্রাপ্য তালিকায় শুধুই বিদ্রুপ, বিড়ালের ডাক। মাঠে কেউ ওঁর চেয়ে বেশি দৌড়য় না, খেলা চালিয়ে যান নিরলস, আর গ্যালারি ওঁর মুণ্ড চায়! কোনওভাবে মাঠে যদি বল ওঁকে ছুঁয়ে ফেলে, স্টেডিয়ামের সবাই একযোগে ওঁর মা-কে অভিশাপ দেয়। তবুও উপেক্ষা করতে পারেন না, চিরন্তন ঘৃণিত হওয়ার চেয়েও যা আকর্ষণীয়, ফুটবল মাঠের মাঝখানে হাজির থাকার টান। আবারও অপমানিত হতে আবারও গায়ে পরে নেন সেই পোশাক, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে যা ছিল শুধুই শোকাবহ, কালো রঙের!’
দক্ষিণ আমেরিকায় জন্মের কারণেই তিনি পূজারী ভাল ফুটবলের। খুঁজে পেয়েছেন পেশাদারিত্বের আগমনে ফুটবল শিল্পের জলাঞ্জলি। ‘আনন্দটাই কেড়ে নিয়েছে, ফুটবল হারিয়েছে প্রাণ। মনের আরাম ছিল খেলাটা। হয়ে গেল সাবধানী, সতর্ক। ওই ম্যানেজারদের পাল্লায় পড়ে। আর পয়সার অশালীন জোরে। কেউ আনন্দ পেতে খেলে না আর। সবারই লক্ষ্য, যেন হারতে না হয়। সারা দিন বসে থাকি টেলিভিশনের সামনে আর ভাবি, একটা মুভ, একটা মুভ দেখাও, পরম শান্তিতে ঘুমোতে পারি যেন। পাই না। পয়সা আর পেশাদারিত্ব একযোগে কেড়ে নিয়েছে ফুটবল দেখে আনন্দ পাওয়ার সেই সহজসরল দিনগুলো। বিউটি হেরে গিয়েছে ডিউটির কাছে।’
ফুটবলের জন্ম থেকে ২০১০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ধারাবিবরণী। ছোট ছোট অধ্যায়। আসলে দুই বা তিন প্যারাগ্রাফ। এমন অধ্যায় প্রায় দেড়শো বা তারও বেশি। হাতেগোনা কয়েকটি, পাতা দেড় বা দুয়েক। বাকি সব সীমাবদ্ধ দেড়শো শব্দে। এমনই সেই শব্দগুচ্ছের মহিমা, মুখস্ত করে ফেলতে ইচ্ছে হবে। না-চাইলেও মনে থেকে যাবে কবিতার বিশেষ বিশেষ পঙক্তির মতো।
‘১৯০২ সালে রুডইয়ার্ড কিপলিং ফুটবলকে বিদ্রুপ করে লিখেছিলেন কর্দমাক্ত গণ্ডমূর্খদের হৃদয়ের সন্তুষ্টি। শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ পরে লুই হোর্খে বোর্হেস যে দিন বুয়েনোস আইরেসে অমরত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, শহরের অন্যপ্রান্তে আর্জেন্তিনা তখন খেলতে নেমেছিল সেই বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচ…
‘… বহু বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ফুটবলকে অপমান করেন। তাঁদের মনে হয় জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে ফুটবল, বিপ্লবের পথ থেকে বিচ্যুত করে। ওঁরা বলেন ব্রেড অ্যান্ড সার্কাস! অথবা, যে-সার্কাসে রুটি নেই। একটা বলেই সম্মোহিত। বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন। শ্রমিকরা ভুলে যায় তারা আসলে কে বা কী। শ্রেণীশত্রুদের হাতে ভেড়ার পালে ভিড়ে যায়।
‘… একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বুয়োনোস আইরেসের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আবার ফুটবলকে বিবেকের ঘুমপাড়ানি ওষুধ তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে মেতে উঠেছিলেন উৎসবে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইতালীয় মার্কসিস্ট আন্তোনিও গ্রামসি। প্রশংসায় বলেছিলেন, ‘ফুটবল হল ‘মুক্ত-হাওয়ার রাজত্বে মানবিক আনুগত্যের উৎসব।’’
গদ্য এমন হলে, প্রতি বাক্যে বারবার থামতে হয়, সত্যি গলঃধকরণের স্বাভাবিক সময়টুকু পেতে। বই পড়ার গতি তবুও ব্যাহত হয় না। কারণ, উপলব্ধির পর তীব্র আকর্ষণে পরের লাইন বা পাতায় চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা তখন দুর্নিবার। আর সেই আকর্ষণই টেনে নিয়ে যায় বারবার, বইয়ের পাতা ওল্টানোর দিকে। একবার পড়ার পর আরও বহুবার পড়তে বাধ্য করে, নতুন অনুভূতির সন্ধানে।
লেখক ২০১৫ সালে প্রয়াত। কিন্তু এখনও বারবার পঠিত হয় ‘ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’, লেখা হয়, বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে, সমৃদ্ধ হয় মনন। আর, জুড়ে যায় বিশেষণ, ‘ফুটবলের সেরা বই’ ‘ফুটবল-ক্লাসিক’।
প্রচ্ছদ ঘোষণায় সোচ্চার, সাহিত্যে ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড’-এর জবাব খেলায় ‘ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’। কলম্বিয়ার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে একাসনে উরুগুয়ের এদুয়ার্দো গালেয়ানো। দুজনেই লাতিন, ভাবনায় এবং ভাবনা প্রকাশের শব্দে তাই এত মিল, ফুটবলেখায় এনে-দেওয়া যুগান্তর!
ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো
লিখেছেন – এদুয়ার্দো গালেয়ানো
পেঙ্গুইন বুকস
দাম – ৪৯৯ টাকা
প্রকাশিত - খেলা, মে ২০২৩
No comments:
Post a Comment