হিমাচল প্রদেশের কুলু জেলায় জালোরি পাস থেকে খানিক দূরে অবস্থিত সেরোলসার লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে দশ হাজার ফুট ওপরে। গাছপালায় ঘেরা। এতটাই যে, চোখেও পড়ে না। সেই হ্রদের জল সবসময় স্বচ্ছ, নির্মল। গাছের একটা পাতাও পড়ে থাকতে দেখা যায় না। কথিত, ‘আভি’ নামক প্রজাতির ছোট পাখি ঠোঁটে তুলে নিয়ে যায় পাতা বা পাখির পালক, জলে পড়লেই। সেই জলের দেবী বুধি নাগিনকে সন্তুষ্ট রাখতে নাকি স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছিল দায়িত্ব।
লিওনেল মেসি আসলে সেই পাখিটার মতো। ফুটবল নামক পবিত্র জলাশয়কে যিনি কখনও অপরিষ্কার থাকতে দেন না। কাউকে নোংরা করতে দেখলে, পায়ে করে তুলে নিয়ে যান ঝরাপাতা। কলুষতাময় আজকের ফুটবল থেকে পাঁক সরাচ্ছেন স্বেচ্ছায়। স্বচ্ছ, পবিত্র রাখছেন জল। যে–ছবি ছেপে দেন মনে, থেকে যায় অমলিন আজীবন। আর সেই নির্মল জলে অবগাহনের দুর্নিবার নেশায় ছুটে আসে দূর–দূরান্তর দেশ–দেশান্তরের মানুষ।
যেমন, জলে নেমেছেন ব্রাত্য বসু। নাট্যকার যিনি ফুটবল–ভক্ত। উরুগুয়ের এদুয়ার্দো গালেয়ানোর ‘ফুটবলের রৌদ্রছায়া’য় যাঁর মনে বর্ষা আসে, বসন্তও। পড়ুয়া–মন খুঁজে পড়ে ফেলে বাংলায় লেখা ফুটবলের ‘ম্যাগনাম ওপাস’, উত্তর কলকাতার কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফুটবল ঘরানা: বিপ্লব ও বিবর্তন’। আর, ফুটবলের রূপসাগরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন অরূপরতন মেসিকে, মহাকাব্যের অংশ হিসাবে।
দে বুক স্টোর থেকে প্রকাশিত ‘‘একটি ‘সাহিত্যিক’ মহাকাব্যের কিস্সা লিওনেল আন্দ্রেস মেসি’’ আকারে ততটাই ছোট ব্যপ্তিতে যতটা বিরাট। সম্ভবত একশো কুড়ি জিএসএম কাগজে ছাপা ঝকঝকে রঙিন, কুশল ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদে ‘ফোর স্টার’ মেসির পাশে পঞ্চম তারা হয়ে ফুটে আছে ফুটবল। সেই আকর্ষণে বই হাতে তুলে নেওয়ার পর সুখপাঠ্য গদ্যে ১৬৮ পাতার চলনেও অবিকল মেসি। কখনও সে ছুটছে বাঁদিকের প্রান্তরেখা ধরে দুর্বার, কখনও ভেতরে ঢুকে আসছে, দাঁড়াচ্ছে ক্ষণকাল, বেরিয়ে আসছে সেই দুরন্ত পাস, কখনও আবার পৌঁছচ্ছে সরাসরি গোলে, মাঝে অপার্থিব ওয়ান–টু।
কেন ‘লিটারারি এপিক’, ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। ‘‘পাশ্চাত্যে মিলটন যদি ‘প্যারাডাইস লস্ট’ বা ভার্জিল যদি ‘ঈনীড’ বা দান্তে যতই ‘ডিভাইন কমেডি’ লিখে থাকেন, বা প্রাচ্যে যদি মধুসূদন লেখেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, তার মধ্যে থাকবে যুগের কৌম দাবির পাশাপাশি ব্যক্তির বিপন্নতা, সংগ্রাম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির এক গহন আখ্যান। সেই আখ্যানের তীব্রতা ও ঘনপিনব্ধতা জাতির পাশাপাশি কোনো কোনও ব্যক্তির সাফল্য, পরাজয়, জটিলতা, হতাশা, আর্তনাদ ও উচ্ছ্বাসকে লিপিবদ্ধ করতে করতে যাবে। পণ্ডিতেরা একে বলছেন ‘লিটারারি এপিক।’ ... আর এই লিটারারি এপিক তথা সাহিত্যিক মহাকাব্যের যদি এই নতুন শতাব্দীতে সর্বোত্তম কোনো ফুটবলীয় উপমান থেকে থাকেন, তবে তার নাম নিঃসন্দেহে আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। এই নশ্বর গ্রহে একমাত্র অবিনশ্বর লোকগাথা, যিনি জনপ্রিয় ব্যালাডের মতোই লোকশ্রুতি বা লোকগীতি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে, এক বিশ্ব থেকে অন্য বিশ্বে।’
মনে পড়ল কাতার বিশ্বকাপ। লুসেইল স্টেডিয়ামে তিনি চললেন, মাঠের ডানদিক দিয়ে বাঁপায়ে বল নিয়ে। প্রায় ৫৫ গজ দৌড়লেন, বল তাঁর পোষ্য হয়ে লেগে থাকল পায়ে, গায়ে গা ঘষল। ওপাশ থেকে মুখোশধারী ক্রোয়েশীয় এলেন। একবার এদিক দেখিয়ে ওদিক, পরেই ঠিক উল্টোটা, কোমড়ের মসৃণ মোচড়ে। যিনি এসেছিলেন কাড়তে, নেটওয়ার্ক সীমানার বাইরে! মেসি আরও এগোলেন, জঙ্গলের ভেতর। শেষ সীমায় সামনে আবার দু’জন, দুটি কোণ আটকে। অনভ্যাসের ডান পায়ে পাসটা এল, ‘গোল করে যা’ নিমন্ত্রণ নিয়ে। হুলিয়ান আলবারেজ করলেন। ক্লেদমুক্তি চার বছর আগের নিঝনি নভোগোরোদের ০–৩ স্মৃতি থেকে। পাতাটা জল থেকে তুলে ফেলে দিলেন যেন!
কাজ সেরে গভীর রাতের কাতার মেট্রোয় ফিরছি, হাজার–হাজার মেসি–জার্সি সঙ্গী। সবার মোবাইলে চলছে সেই গোলের ভিডিও। মুখে গান। শব্দগুলো চিনি না। শুধু শুনছি আর গোটা পাঁচেক শব্দের পরই মেট্রোর ছাদে–দেওয়ালে, বা, পাশের ‘মেসি’র গায়ে, জোরালো থাপ্পড়। ঠিক যেন সমে ধা!
স্প্যানিশে সেই শব্দগুলো বোধহয় বাংলায় বহুকাল আগে লিখে গিয়েছিলেন কোনও এক নিবারণ চক্রবর্তী, ‘আমরা যাব যেখানে কোনো/ যায়নি নেয়ে সাহস করি...’
ব্রাত্য বসু সেই সাহসী নাবিক। লাতিন আমেরিকার ঘরানা মেনে লিখেছেন বাংলায়। বাঙালি পাঠককে যা নিয়ে যাবে সেই অচিন দূরত্বে যেখানে পারানি একমাত্র ফুটবল!
একটি ‘সাহিত্যিক’ মহাকাব্যের কিস্সা লিওনেল আন্দ্রেস মেসি
লিখেছেন — ব্রাত্য বসু
দে বুক স্টোর
৪৫০ টাকা
প্রকাশিত : আজকাল, রবিবাসর, ১ জুন ২০২৫
No comments:
Post a Comment