** আজ ২৩ জুন দুজনের জন্মদিন। প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের ছোঁয়াচ থেকে অনেক দূরে এখন। জিনেদিন জিদানের কাছাকাছি তো স্বপ্নেই যাওয়া যায় শুধু...
অসম্ভব প্রাণবন্ত লেখা, সাবলীল শাণিত যুক্তি। ভাষা, পুরুষ হলেও, সরাসরি বেঁধে বুকে, কারণ, মহিলার্বিশেষে সর্বজনীন সেই আবেদন। বাংলার গায়ক কবীর সুমন তো কবেই গেয়েছিলেন, ‘তোমার শরীরে আমার আদর বৃষ্টির মতো ঝরে/ ওদিকে নপুংসকেরা কাউকে গণধর্ষণ করে।’ প্রণম্য সেই ভাবনা এবং সেই ভাবনার শালীন প্রকাশভঙ্গি।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের লেখিকা সু মট-এর লেখার প্রতিপাদ্য ছিল, মিসেস সাইমন্ডস, অ্যান্ড্রু সাইন্ডস-এর মা, আপনার মাতৃসত্তাকে কি অবমাননা করলেন হরভজন সিং?
কোনও সন্দেহ নেই, সুবিচার করেননি হরভজন। বিশেষত সেই ছেলে যাঁর মনে এখনও মায়ের প্রতি সেই ভক্তিভাব যা তাঁকে দিয়ে মাকে ফোন করায়, যখনই কোনও সমস্যায় পড়েন। এমনকি, আপিলস কমিশনারের কাছে মুক্ত ঘোষিত হওয়ার পরও।
কিন্তু যে ভাবে প্রাণখুলে সমর্থন জানানো উচিত ছিল, মন থেকে সেই সায় পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সহজবোধ্য। সু মটের লেখনী আশ্চর্যরকম নীরব আর একজন সম্পর্কে – ব্র্যাড হগ।
ভারতীয় ক্রিকেটারদের ‘বাস্টার্ড’ বলেছিলেন হগ, বাংলায় যা বেজন্মা। আক্ষরিক অর্থ বলছে, একই অপরাধ। মাতৃত্বের অবমাননা যদি ‘তেরি মা-কি’ গালাগালিতে থাকে, বেজন্মা শব্দেও আছে, হয়ত আরও বেশিই। সু মট, আপনার সেটা মনে হল না?
লেখকের নিরপেক্ষতার শর্ত মেনে নিলে হরভজন যে-অপরাধে দোষী, হগও। তাই একযাত্রায় পৃথক ফল করে সু মট, আপনি ব্যর্থ হলেন আপনার সেই লেখায় আপামর মাতৃজাতির অসম্মানের পাশে কলম খুলে দাঁড়াতে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আপনার কলম তখন শুধুই ধরে তুলল আপনার ভারত-বিদ্বেষ, বোধহয়, আরও বড়, অশ্বেতকায় বিদ্বেষের কথা, বকলমে সোচ্চার হল ঘোষণায়, ‘কী সাহস! কালো চামড়ার লোক সাদা চামড়ার মায়ের ইজ্জত নিয়ে প্রশ্ন তুলবে?’ (যদিও সাইমন্ডস কৃষ্ণাঙ্গ, কিন্তু অস্ট্রেলীয়!)
মায়ের কোনও গায়ের রঙ নেই, থাকে না, হয় না, মহিলা হয়েও বুঝলেন না সু মট? ফিরবেন নাকি বাঙালি নাগরিক কবিয়ালের কাছে? ‘একই জল একই পানি / সাগরে সাগরে নাচে / প্রথমমায়ের প্রসব বেদনা / পৃথিবীর মনে আছে / কেউ সাদা কেউ কালো / রঙিন বলেই ভালো /রঙমশালটা একলা জ্বেলো না / আমার বুকেও জ্বালো...’
২
২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন দুয়েক পর এক ফরাসি কাগজের প্রশ্ন ছিল, ‘জিনেদিন জিদান, আপনার সন্তানের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবেন তো আপনি?’
সেদিনও বুঝিনি, এখনও বুঝি না, কেন দাঁড়াতে পারবেন না জিদান, তাঁর সন্তানের সামনে মুখ তুলে, কী অপরাধে!
জিদান কি কোনও অপরাধ করেছিলেন? কোনও এক মার্কো মাতেরাজ্জি প্রথমে তাঁর স্ত্রী, পরে তাঁর বোনকে অপমানের পর, শেষে তাঁর সেই সকালে হাসপাতালে ভর্তি–হওয়া মা–কে বলেছিলেন ‘টেররিস্ট হোর’। তাঁর বুকে ঢুঁসো না–মারলে আর কী করতেন জিদান?
খুব সহজ প্রশ্ন, যে–কোনও কারণেই হোক, কেউ আপনার তিন ভালবাসার পাত্রী সম্পর্কে এইভাবে চরম অশ্লীল ইঙ্গিত ক্রমাগত করে গেলে কী করতেন আপনি?
বরঞ্চ, পাল্টা প্রশ্ন থাক ছাপার অক্ষরেই, নিজের সন্তান বড় হওয়ার পর তাঁর মুখের দিকে তাকাতে পারবেন কি মাতেরাজ্জি, বলতে পারবেন কি কীভাবে এসেছিল তাঁর বিশ্বজয়ের কাপ, যা নিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলেন, সস্নেহ চুম্বন এঁকে দিয়েছিলেন যার গায়ে বিশ্বজয়ের মুহূর্তে? তাঁর সন্তান তাঁকে প্রশ্ন করলে কী জবাব থাকবে মাতেরাজ্জির কাছে তখন? কিংবা, তাঁদের মা–কে কেউ ‘টেররিস্ট হোর’ বললে বাবাকে ছেড়ে জিদান–পন্থী হয়ে সেই বক্তার টুটি টিপে ধরার ইচ্ছে যদি সেই সন্তানের না–জাগে, সন্তান কেন?
ফুটবল খেলেন বা কোনও খেলা খেলেন বলেই নাকি আপনি অ–মানবিক! বলা হবে, ‘এ তো স্ট্র্যাটেজি, কৌশল। ফাঁদ–পাতা, যাতে আপনি ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেন, বিপক্ষ জেতে। এ নিয়ে এত তত্ত্বকথা কীসের?’
না, না এবং না।
খেলছেন বলেই যে কোনও বিপক্ষের মৌখিক অধিকার থাকবে আপনার প্রিয়তমার ‘জার্সি খুলে নেওয়ার’, এই অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি। খেলা পার্থিব সমাজ–বহির্ভূত, মঙ্গল গ্রহের কোনও বস্তু নয়। খেলার আইনও সভ্যতার পরিপন্থী হতে পারে না বা সভ্যতার সীমারেখা লঙ্ঘনের অধিকার পেতে পারে না যেমন, কোনও অদক্ষতার পরিপূরকও হয়ে উঠতে পারে না কখনও।
মানবিক স্বতঃস্ফূর্ততার স্বাভাবিক প্রকাশ খেলার মাঠে। নিবিড় অনুশীলনে সেই দক্ষতা নিপুণতর করে তোলার বাহ্যিক মাধ্যম খেলা। সেখানে এই সভ্যজগত বহির্ভূত অনাচার কেন? কেন অক্লেশে কেউ কাউকে ক্রমশ যা–ইচ্ছে–তাই বলেই চলবেন আর অন্যপক্ষকে শুনে যেতেই হবে, দক্ষতার হিসেবে এগিয়ে থাকার ‘অপরাধে’?
‘কিন্তু, খেলার মাঠে অমন তো হামেশাই হয়!’
যেন হামেশা যা হয়, সব ভাল! তা হলে গ্যালিলিওকে অন্ধ হতে হবে কেন, সত্য বিশ্বের চোখের সামনে আনার জন্য? বিশ্ব তো তেমনই জানত, সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে!
‘খেলতে এসেছিস, বাচ্চা না মেয়ে? পুরুষালি খেলা, লাথি–কনুই খেতে হবে, গালাগাল খেতে হবে, পারলে ফিরিয়েও দিতে হবে, তবেই না! খেলতে এসে গালাগাল শুনবি না, এই মেয়েলি কান্নাকাটির কোনও মানে হয়?’
যেন গালাগাল পৌরুষের প্রতীক!
নিজের সীমাবদ্ধতা ঢাকতে আর কত নীচে নামব আমরা? চুরি করব, আইন দেখতে পায়নি বলে ফাঁক খুঁজব, খেলোয়াড়ের জন্ম–বর্ণ নিয়ে প্রশ্ন তুলব, তুলতেই থাকব, থুথু ছেটাব, অভিনয় করব, যাকে দেখতে পারি না, চলন বেঁকা বলে অভিযোগ আনব, আর, বলে যাব ‘স্ট্র্যাটেজি’ — শত ধিক এমন পৌরুষে!
৩
বড় ম্যাচের আগে পিকে ব্যানার্জির বহুল প্রচারিত ভোকাল টনিকেও সেই ‘মা’!
জার্সি মাটিতে রেখে দিতেন। বলতেন, ‘জার্সি তোমাদের মা, আর সেই মায়ের সম্মান নিয়ে টানাটানি করতে চাইছে কেউ, তোমরা কি মুখ বুজে সহ্য করবে?’
সাতের দশকের অনেক ফুটবলারের মুখেই শোনা, শুনেই চেগে যেতেন, অসহ্য রাগ ভর করত, ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হত বিপক্ষকে। এখন, এত দিন পর, সেই ভোকাল টনিকের তেজ কমেছে বহু ব্যবহারে। তবু, এখনও কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্তে তা রীতিমতো কাজে দেয়, অনেকে এখনও এই বিশেষ আর্তিতে উদ্বুদ্ধ হন, ভালই তো।
আবার, সেই মায়ের সম্মানার্থে মাঠে নেমে বিপক্ষের কোনও ফুটবলারকে সেই ‘মা–মাসি উদ্ধার করে দেওয়া’ গালাগাল করতেও কি পিছপা হয়েছিলেন বা হয়েছেন কেউ কখনও? তা হলে, লাভ কী? এক মায়ের সম্মান রক্ষার্থে নিজে লড়ছেন, আবার সেই মায়ের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়ে বিপক্ষকেও তো তাতিয়ে দিচ্ছেন, লাভ কার?
কেন এমন হবে না যে, মানুষকে তাতিয়ে তোলার জন্য আদিম প্রবৃত্তির ব্যবহার করাই ছেড়ে দেবে ক্রীড়া জগৎ?
উত্তেজনার বশে অনেক কিছুই হয়ে যাওয়া আর অশ্লীল গালিগালাজে নিজেদের উদ্দীপ্ত করা, এক হতে পারে কখনও, নাকি হয়?
কেন ফুটবল মাঠে নামার সময় মার্কো মাতেরাজ্জিকে ভাবতে হবে, জিদানকে কী কী বলে তাতানো যায়, কেন গ্লেন ম্যাকগ্রাথকে মনে রাখতেই হবে, কোনও এক বিশেষ সময় রামনরেশ সারওয়ানের বউ–এর কথা তুলতেই হবে, কেন হরভজন সিং–এর বল খেলতে না–পারলে রিকি পন্টিংকে আনতেই হবে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ, কেনই বা ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে আটকাতে না–পেরে তাঁর গায়ের রঙ তুলে গাল পেড়ে থুথু ছেটাতে বাধ্য করতে হবে রুডি ফোলারকে এবং সেই কাজে সায় থাকবে কাইজার বেকেনবাওয়ারের?
এবং, আরও বড়, জিদান–গাভাসকারদের দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবাদ সত্ত্বেও, এমন ঘটনা কি চলতেই থাকবে, আজও, গোটা পৃথিবী জুড়ে?
বন্ধ হবে না খেলার মাঠের এই মাতৃ–দূষণ?
প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তর, আজও অজানা!
*প্রকাশিত, খেলা ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
2 comments:
দারুণ লেখা
অজস্র ধন্যবাদ ‘পরিচয় গুপ্ত’ স্যর :)
Post a Comment