নয়ের দশকের প্রথমভাগ। ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের প্রশ্ন। বিষয় — টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিন। টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দিন শেষে দলের রান চার উইকেটে ১৮২। কোনও ব্যাটসম্যান ৫০ পেরননি। জুটিতেও একবারই সর্বোচ্চ ৫৮। পড়েছে চার উইকেট, বোলারদের কারও পাঁচ উইকেট নেওয়ার প্রশ্নই নেই। সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দে ম্যাচ–রিপোর্ট লিখুন।
জানা হয়নি, প্রশ্নকর্তা ইউপিএসসি–র সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষার ‘এসে’ অংশের বিষয় নির্বাচন করে দিতেন কিনা, যেখানে ১২৫ নম্বরের প্রশ্নে হাজার থেকে বারোশো শব্দ লিখতে হত। আসলে, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করার পর সেই যে বন্ধু–অ্যাসপাইর্যান্ট ডব্লুবিসিএস পরীক্ষায় বাংলা থেকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করার জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত থেকে ‘ভগবান যাহাকে তাঁহার বিচিত্র–সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেয়’ লাইনগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হয় জানিয়েছিল, ছিটকে যাওয়া, সভয়। তারই ফলশ্রুতি সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টা। কিন্তু, সেখানেও দেখা গেল সমস্যা এক, একই।
সুবিধা, তখন আমাদের পরীক্ষার হলে চেবানোর জন্য কলম থাকত! আজ হলে কীবোর্ড কী করে চর্বণ করতে হয়, শিখে নিতাম হয়তো। তখন দরকার পড়েনি, নিশ্চিন্তে কলম চিবিয়ে উপাদেয় সন্ধানে পেয়ে গিয়েছিলাম সুনীল গাভাসকারকে। প্রায় ১৭ বছর আগে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে যিনি ৬০ ওভার ব্যাট করে, ১৭৪ বল খেলে অপরাজিত থেকে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন ৩৬ রান নিয়ে। অস্বাভাবিক ‘স্লো’ ম্যাচ–রিপোর্টে সামান্য গতিসঞ্চার করেছিল স্মৃতিতে মাইক ব্রিয়ারলির উক্তি। ক্রিকেট–পত্রিকায় পড়েছিলাম বোধহয়, আদর্শ ওপেনিং জুটি সম্পর্কে ব্রিয়ারলির ভাষ্য। ‘সানি (গাভাসকার) আর জেফ্রি (বয়কট)। টস জিতে ওদের ব্যাট করতে পাঠাব। দিনের শেষে রান ১২০, বিনা উইকেটে। সানি ৮০ নট আউট, জেফ্রির ২০ আর ২০ রান একস্ট্রা।’ বাকিরা লাঞ্চ করে ম্যাটিনি শো দেখতে চলে যাবে কিনা, বলেননি!
দিনকাল সত্যিই অন্যরকম তখন। স্টিভ ওয়ার অধিনায়ক হতে দেরি আছে। ম্যাথু হেডেন, জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ব্যাটে ‘দিনে তিনশো’ থিওরি জন্মায়নি। সৌরভ গাঙ্গুলির মস্তিষ্কেও গান থেকে গুলি ছোটাননি বীরেন্দ্র শেহবাগ। ‘৫০ ওভার মানে ৩০০ বল, প্রতি বলে এক রান করে নিলেই ৩০০, চার–ছয়ের দরকার নেই’, বব উলমারের অমর কৌশলও আসেনি, যা আমূল বদলে দিয়েছিল ক্রিকেট–দর্শন। জনতা সাদা পোশাকের নান্দনিকতায় এতটাই বিভোর, দৈনিক ৮৫–৯০৫ ওভারে সাত–আটটা চার পেলেই খুশি। একটাও ছয় হলে আলোচনায় উচ্ছ্বাস বাঁধনহারা। কাউন্টি ক্রিকেটের মাঠে মেমসাহেবের উলবোনা আর পোষ্যদের খেলা চলত, টেস্ট দেখতে দর্শক মাঠে আসতেন না, আবারও পাঁচদিনে অমীমাংসিত খেলা দেখতে না–চেয়ে।
প্রশ্ন অবশ্য থেকেই গিয়েছিল। খেলা মানে আরও জোরে, আরও দূরে, আরও দ্রুত। সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফর্টিয়াস। সেখানে এমন স্তব্ধতার গান শোনানো কেন? স্বাভাবিকতার সহজাত রাস্তা ছেড়ে পারফেকশনের প্রতিমূর্তি হতে চেয়ে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে–পড়া কি খেলার প্রাথমিক শর্তের বিরোধিতা নয়?
দিন–মাস–বছর যায়। চোখ থেকে মনে উঠে আসেন আন্দ্রে পিরলো। গতিময়তার সঙ্গে যাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। কার্লো আনচেলোত্তি তাঁর নাম দিলেন ‘রেজিস্তা’। বিপক্ষের আক্রমণ শুষে নেবেন ব্লটিং পেপারের মতো, পেশাদার ফাউলের নোংরামি না করে। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকার সমার্থক হয়ে উঠলেন ইতালীয় পিরলো। এমনকী ভারতের ১০০ মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়নের থেকেও ‘স্লো’, কিন্তু বিপক্ষ আক্রমণে যখন, চিন্তায় তঁার চেয়ে ‘ফাস্ট’ তো উসাইন বোল্টও নন!
এই ভাবনাই গড়ে দেয় তফাৎ। খেলার চূড়ান্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোর চেয়ে। বিশেষত দলগত খেলায়। সে ফুটবল হোক, হকি, বাস্কেটবল — সর্বত্র। অলিখিত ‘ক্যাপ্টেন’ থাকেন। তাঁর কাজই গতি কমিয়ে দেওয়া, নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা। ফুটবলে বোঝা সহজ। বলপায়ে বাড়তি কয়েক সেকেন্ড, দেখতে হয়তো অপ্রয়োজনীয়। কিংবা কিছু উদ্দেশ্যহীন পাস, নিজেদের মধ্যে। ‘পজেশন’ ধরে রাখা নিয়ে আজকের ফুটবলে এত কথা! পেপ গারদিওলার বার্সেলোনা যখন পজেশন–নির্ভর প্রেসিং খেলত, আক্রমণ মূল উদ্দেশ্য ছিল। এখন ইওরোপ ক্রমশ আত্মস্থ করে উদ্দেশ্যটা বদলে দিয়েছে নেতি–তে — বিপক্ষ যাতে আক্রমণ করতে না–পারে! স্বাভাবিক, বল যদি নিজের পায়ে থাকে, বিপক্ষ আক্রমণে আসবে কী করে? তাই মিডল থার্ড অঞ্চলে গারদিওলার সিটি পাসের পর পাস খেলে যার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য বল পা–ছাড়া না করা, বিপক্ষকে খেলার সুযোগ না–দেওয়া। বহু মাঠেই বিপক্ষের দর্শক বিদ্রুপ করেন। পজেশন ধরে রাখার এই অকারণ পাসিং যা খেলার গতি নষ্ট তো করেই, ব্যহত হয় খেলার উদ্দেশ্যও, যা সবসময় এগিয়ে যেতে বলে। নেতিবাচক না হলেও যা কখনও ইতিবাচক নয়।
আসলে, শাবি এরনানদেজ–এর মতো ‘শ্লথ’ কেউ না থাকলে যে এমন যুগান্তকারী ভাবনাও ‘গতি’ পায় না! তিনি লিওনেল মেসি নন, একা বলপায়ে দৌড়ে বিপক্ষকে মাটি ধরাবেন না। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও নন, যাঁর ‘অ্যাক্সিলারেশন’ বা বলপায়ে হঠাৎ গতি–বাড়ানো অতুলনীয়। শাবির গুরুত্ব বেশি, কারণ, মেসি–ইনিয়েস্তাদের সেই গতি বা হঠাৎ–গতি বাড়ানোর সুযোগ করে দিতেন। বল পেয়ে নিজের অক্ষের চারপাশে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া, ওই এক সেকেন্ড বা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে থমকে যেত ফুটবল। বিপক্ষ যে–গতিতে আক্রমণে আসতে চেয়েছিল, যেন ‘কমা’ পড়ল। যতিচিহ্নের ব্যবহার, ফুটবল–মাঠে।
খেলার সদাচলমান বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই সহাবস্থান শ্লথতার, অদ্ভুত বৈপরীত্যে। মানু ভাকেরকে পারি অলিম্পিকে দেখছিলাম, পকেটে বাঁহাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। ডানহাতে পিস্তল তুলে আস্তে আস্তে ওঠালেন হাত। ১০ বা ২৫ মিটার দূরে টার্গেট। অদ্ভুত সোজা হাত লক্ষ্যে স্থির হল। কিন্তু, ট্রিগার টানছেন না কেন? অপেক্ষা সেকেন্ড ছাড়িয়ে মিনিটের কাঁটায়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাধারণত ষাটটা শট নিতে হয় পিস্তল–শুটারদের, ৭৫ মিনিটে। ‘টাইম প্রেসার’। অবাক হয়েই দেখছিলাম, পাশের প্রতিযোগীরা যতক্ষণে কুড়ি–বাইশটা ‘শট’ নিয়ে ফেলেছেন, মানুর তখন দশ–এগার। সবচেয়ে বড়, অন্যরা অন্তত পাঁচবার ট্রিগার টেনে ফেলার পর শুরু করতেন মানু! ওই যে হাত–সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা, মানুর মতোই থেকে গিয়েছে এই দর্শকের মনেও। তাঁর যত্ন, তাঁর প্রস্তুতি, তাঁর ভালবাসা। ১২–১৫ শটের পর পিস্তল হাত থেকে নামিয়ে রেখে পেছনে ফিরে গ্যালারিতে কোচ যশপাল রানাকে খোঁজা, চোখের ইশারায় কথা একটা–দুটো। পাশেই ছিলেন যশপাল, দেখছিলাম তাঁকেও, হাতটা বুকের সামনে উঁচু করে অভয় দিয়ে যাচ্ছেন শুধু। সেই হাতের ভাষাকে শব্দ দিলে ‘শান্ত হও, আরও শান্ত, লক্ষ্যে স্থির থাকো, ব্যস’। ব্রোঞ্জ পেয়ে মানু এসে বলেছিলেন, রোজ সকালে গীতাপাঠ আবশ্যিক করেছেন তাঁর কোচ, আর যোগাভ্যাস। ‘কম্পিটিশন’ নয়, যে–অভ্যাসে মন শান্ত হয়। যে খেলার যা!
মানুর খেলার সঙ্গে না হয় ওতপ্রোত জড়িত মনের শান্তি, শেষে যা নিয়ন্ত্রণ করবে তাঁর হাতের নড়াচড়া। কিন্তু বরিস বেকার? তাঁর তো নামই ছিল ‘বুমবুম’! খেলতেনও চিরন্তন একাকীত্বের প্রতীক যে–খেলা — টেনিস। বেকারকে সার্ভিস করতে দেখেছেন নিশ্চয়ই। মনে না পড়লে ইউটিউবে গিয়ে আবারও দেখতে পারেন। কী অদ্ভুত প্রশান্তি! বলবয়ের হাত থেকে বল পেলেন। দাঁড়ানোটা দেখুন। আম্পায়ার ‘সাইলেন্স’ বলেছেন বা বলেননি। বেকার হঠাৎ হারিয়ে গেলেন জগৎসংসার থেকে! মাথা নীচু, কয়েক সেকেন্ড। প্রস্তুতির ওই যত্নটুকু। বাঁহাতে বল তুললেন আকাশে, ডানহাতে উঠল র্যাকেট। সংযোগে বলের ছিটকে যাওয়া নেটের ওধারে। প্রতিক্রিয়া তো তারপর, আগের এই প্রক্রিয়া যখন তিনি ‘বুমবুম’ সত্তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নিজেকে নিবিষ্ট করছেন, তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সর্বকালের সেরাদের তালিকায়। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাকেও দেখেছি, অবিকল একই রকম। ওই এক পলকের একটু দাঁড়ানো, থমকে–থাকা। খেলায় সাফল্যের অন্যতম শর্ত।
ধীরতা–স্থিরতার এই কমা–সেমিকোলনগুলোই খেলার বাক্যকে করে তোলে চূড়ান্ত গতিশীল, যত্ন–ভালবাসার যতি–তে। যেমন পদ্যের মাঠে শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
** প্রকাশিত, রোববার, সংবাদ প্রতিদিন, ৮ জুন ২০২৫
4 comments:
একটা লেখার শিরোনাম - স্তব্ধতার গান। আর লেখাটার শেষ লাইন - "যেমন পদ্যের মাঠে শক্তি চট্টোপাধ্যায়।"
লেখাটার ছত্রেছত্রে থাকবে অগুনতি মীড়ের কাজ। অসম্ভব মসৃণ গতিতে একটা বাক্য গড়িয়ে যাবে পরের বাক্যে, এক খেলার মাঠ থেকে আরেক খেলার মাঠে, এক কিংবদন্তী থেকে আরেক প্রবাদপ্রতিমে। সুনীল গাভাসকর থেকে শুরু করে মানু ভাকের - কী অনায়াস বরিস বেকারের সঙ্গে যশপাল রানার সঙ্গত! এরকম কবিতার মতো প্রবন্ধ খুব কম পড়েছি।
থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু 🙏 এত মন দিয়ে পড়বি জানলে আরও মন দিয়ে লিখতে হোত যে 😀
আরও বেশি বেশি করে লিখো প্লিজ।
নেমন্তন্ন পাইলেই লিখে ফেলি তো 🤣🤣
Post a Comment